প্রশ্ন; আর কেউ আপত্তি করেনি?
উত্তর : আর কারুর আপত্তি করার সাহস নেই।
প্রশ্ন : বাড়িতে কারুর সঙ্গে হেনার মেলামেশা ছিল না?
উত্তর : মেলামেশার বাধা ছিল না। তবে হেনা মিশুকে মেয়ে ছিল না, বাপ-মায়ের মৃত্যুর শকটাও বোধহয় সামলে উঠতে পারেনি। তাই সে একা-একাই থাকতো, নিজের ঘর ছেড়ে বড় একটা বেরতো না।
প্রশ্ন : সে রোজ সন্ধ্যেবেলা তেতলার ছাদে উঠে। বেড়াতে আপনি জানেন?
উত্তর : আগে জানতাম না, আজ জানতে পেরেছি।
প্রশ্ন; কার কাছে জানতে পারলেন?
উত্তর : যে আমাকে টেলিফোনে মৃত্যু-সংবাদ দিয়েছিল তার কাছে।
প্রশ্ন: কে মৃত্যু-সংবাদ দিয়েছিল?
সন্তোষবাবু কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়া রহিলেন, তারপর মুখ তুলিয়া বলিলেন, ‘তাই তো, কে খবর দিয়েছিল তা তো লক্ষ্য করিনি। আমি যেখানে ছিলাম। সেখানকার ঠিকানাও তো কেউ জানে না।’ তিনি হঠাৎ রবিবর্মার দিকে তীব্র চক্ষু ফিরাইয়া বলিলেন, ‘রবি।’
রবিবর্মা গাঢ়স্বরে বলিল, ‘আৰ্জেজ্ঞ না, আমি ফোন করিনি।’
আমরা একবার মুখ তাকাতাকি করিলাম। এ কে রে বলিলেন, ‘টেলিফোনে গলার আওয়াজ শুনে চিনতে পারেননি?’
সন্তোষবাবু বলিলেন, ‘খবরটা পাবার পর অন্য কোন প্রশ্ন মনেই আসেনি। কিন্তু–’
এ কে রে এবার অনিবাৰ্য প্রশ্ন করিলেন, ‘আপনি কোথায় ছিলেন?’
সন্তোষবাবুর মুখে ঈষৎ রক্তসঞ্চার হইল, তিনি একে একে আমাদের সকলের মুখের উপর দৃষ্টি বুলাইয়া বলিলেন, ‘একথা জানা কি নিতান্তাই দরকার?’
এ কে রে একটু অস্বস্তি বোধ করিতেছেন, তাহা তাঁহার ভাবভঙ্গী হইতে প্রকাশ পাইল; তিনি অপ্রতিভভাবে বলিলেন, ‘আমাকে ক্ষমা করবেন, কিন্তু হেন মল্লিকের মৃত্যু সম্বন্ধে আমি এখনো নিঃসংশয় হতে পারিনি। খুব সম্ভব সে অসাবধানে ছাদ থেকে নিজেই পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু কেউ তাকে ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল— এ সম্ভাবনাও একেবারে বাদ দেওয়া যায় না। তাই সব কথা আমাদের জানা দরকার।’
সন্তোষবাবু ভ্রূ তুলিয়া কিছুক্ষণ এ কে রে’র পানে চাহিয়া রহিলেন, তারপর বলিলেন, ‘হেনকে কেউ ঠেলে ফেলে দিয়েছিল এ সম্ভাবনাও আছে?’
এ কে রে বলিলেন, ‘আজ্ঞে আছে।’
সন্তোষবাবু ঈষৎ গলা চড়াইয়া বলিলেন, ‘কিন্তু কে তাকে মারবে? কেন মারবে?’
এ কে রে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ‘তা এখনো জানি না। কিন্তু সব সম্ভাবনাই আমাদের অনুসন্ধান করে দেখতে হবে।’
সন্তোষবাবু আবার কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়া বসিয়া রহিলেন, তারপর সহসা খাড়া হইয়া বসিলেন; কড়া চোখে আমাদের সকলকে নিরীক্ষণ করিয়া কড়া সুরে বলিলেন, ‘বেশ, কোথায় ছিলাম বলছি। কিন্তু এটা আমার জীবনের একটা গুপ্তকথা, এ নিয়ে যেন কথা-চালাচালি না। হয়।’
‘কথা-চালাচালি হবে না। আপনি যা বলবেন, অফ-রেকর্ড থাকবে।’ এ কে রে অন্য পুলিস কর্মচারীদের ইশারা করিলেন, তাহারা উঠিয়া হল-ঘরে গেল, রাইটার জমাদারও খাতা বন্ধ করিয়া শুনা করিল। ব্যোমকেশ উঠিবার উপক্রম করিয়া বলিল, ‘আমরাও তাহলে পাশের ঘরে গিয়ে বসি।‘
সন্তোষবাবু হাত তুলিয়া দৃঢ়স্বরে বলিলেন, ‘না, আপনারা বসুন। আপনি উপস্থিত আছেন ভালই হল, আমি আপনাকে আমার পারিবারিক স্বার্থরক্ষার কাজে নিযুক্ত করলাম।’
ব্যোমকেশ আবার বসিয়া পড়িল। সন্তোষবাবু আর-একটা সিগারেট ধরাইয়া মৃদু মৃদু টান দিতে লাগিলেন, আমরা অপেক্ষা করিয়া রহিলাম।
চিংড়ি দ্বারের নিকট হইতে গলা বাড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, চা নিয়ে আসব?
সন্তোষবাবু বলিলেন, ‘এস।’
চিংড়ি ঘরে প্রবেশ করিল। তাহার পিছনে খাবার ও চায়ের ট্ৰে লইয়া দুইজন ভৃত্য। চিংড়ি আমাদের সামনে চা ও জলখাবারের রেকবি রাখিতে রাখিতে একবার বিস্মফারিত নেত্ৰে ব্যোমকেশের পানে চাহিল। নেংটির নিকট নিশ্চয় ব্যোমকেশের পরিচয় শুনিয়াছে। তাহার দৃষ্টিতে কৌতূহল ছাড়াও এমন কিছু ছিল, যাহা নির্ণয় করা কঠিন। বোধহয় সে মনে মনে ভয় পাইয়াছে।
সন্তোষবাবু বলিলেন, ‘বাইরে যাঁরা আছেন তাঁদেরও দাও।’
চিংড়ি চাকরদের লইয়া হল-ঘরে গেল, রবিবর্মা বাহিরে গিয়া নিঃশব্দে দ্বার ভেজাইয়া দিল।
আমরা পানাহারে মনোনিবেশ করিলাম। সন্তোষবাবু কেবল এক পেয়ালা চা লইয়াছিলেন, তিনি তাহাতে একটু মৃদু চুমুক দিয়া আমাদের দিকে না চাহিয়াই বলিতে আরম্ভ করিলেন, ‘আমি অকলঙ্ক চরিত্রের লোক নই, কিন্তু সেজন্যে নিজেকে ছাড়া কাউকে দোষ দিই না। আমার অসংখ্য দোষের মধ্যে একটা দোষ, আমি কীর্তন শুনতে ভালবাসি।’
আমরা মুখ তুলিয়া চাহিলাম। রাজনীতির ক্ষেত্রে সন্তোষবাবু বিখ্যাত বক্তা্্, তিনি যে তাঁহার গুপ্তকথা মৰ্মস্পশীী ভঙ্গীতে বলিবেন তাহাতে সন্দেহ রহিল না। বস্তুত তাঁহার প্রস্তাবনার বৈচিত্র্যে তিনি আমাদের অখণ্ড মনোযোগ আকর্ষণ করিয়া লইলেন।
আর-এক চুমুক চা পান করিয়া তিনি সিগারেটে লম্বা টান দিলেন, তারপর পেয়ালার মধ্যে সিগারেটের দগ্ধাংশ ফেলিয়া এক পাশে সরাইয়া রাখিতে রাখিতে বলিতে আরম্ভ করিলেন,–
‘কীৰ্তন-গাইয়ে সুকুমারীর নাম বোধহয় আপনারা শুনেছেন। গান গাওয়া তার ব্যবসা, টাকা নিয়ে সভায়-মজলিশে গান গায়। দশ বছর আগে তার গান শুনে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমার দাম্পত্য-জীবন সুখের নয়, আমি সুকুমারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। তখন সুকুমারীর বয়স বাইশ-তেইশ বছর। কিছুদিন লুকিয়ে তার বাড়িতে যাতায়াত করেছিলাম, তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। কিন্তু তার বাড়িতে নানা রকম লোক আসত, কেউ গান শুনতে আসত, কেউ বায়না দিতে আসত। দেখলাম, এখানে যাতায়াত করা আমার পক্ষে নিরাপদ নয়।