মগ্নমৈনাক

‘আপনারা জানেন‌, আমার জীবন রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। স্বাধীনতার যুদ্ধে দেশ-বিভাগের সময় দুই পক্ষের মধ্যে দূতের কাজ করেছি। রাজনীতির ক্ষেত্রে আমার খ্যাতি আছে‌, প্রতিপত্তি আছে। তেমনি আবার শত্ৰুও আছে। শত্রুপক্ষ যদি আমার নামে কলঙ্ক রটাবার সুযোগ পায়‌, তাহলে আমার যশ পদমর্যাদা কিছুই থাকবে না। ভেবে-চিন্তে আমি এক কাজ করলাম‌, বেনামে একটি ছোট্ট বাড়ি ভাড়া নিলাম। উদ্দেশ্য‌, সুকুমারীকে সেখানে নিয়ে গিয়ে তুলিব‌, তার প্রকাশ্য গায়িক-জীবন শেষ হবে। কিন্তু সুকুমারী তাতে রাজী হল না। শেষ পর্যন্ত স্থির হল সে নিজের বাসাতেই থাকবে এবং গানের ব্যবসা চালাবে‌, কেবল হগুপ্তার মধ্যে দুদিন‌, শনিবার এবং রবিবার‌, সে আমার ভাড়া-করা গোপন বাড়িতে এসে থাকবে। আমি সেখানে এমনভাবে যাতায়াত করব যে কেউ জানতে পারবে না।

‘গত দশ বছর ধরে এইভাবে চলেছে। আমি শনিবার বিকেলের দিকে অফিসের কাজ সেরে সেখানে চলে যাই‌, তারপর সোমবার সকালে সেখান থেকে সটান অফিসে যাই। আজও তাই হয়েছিল‌, বেলা আন্দাজ সাড়ে তিনটের সময় সেখানে গিয়েছিলাম। তারপর— রাত্রি আটটার সময় টেলিফোন পেয়ে তৎক্ষণাৎ চলে এলাম।’ তাঁহার মুখে নীরস ব্যঙ্গ ফুটিয়া উঠিল‌, ‘এই আমার অ্যালিবাই।’

ব্যঙ্গের খোঁচা হজম করিয়া এ কে রে বিনীত স্বরে বলিলেন‌, ‘ধন্যবাদ। খৃষ্টতা ক্ষমা করবেন‌, আর দু-একটা প্রশ্ন করেই আপনাকে নিস্কৃতি দেব। ভাড়াটে বাড়িতে চাকর-বাকর কেউ আছে?

সন্তোষবাবু বলিলেন‌, ‘না‌, ইচ্ছে করেই চাকর রাখিনি। প্রত্যেক শনিবার দুপুরবেলা সুকুমারী নিজের বাসা থেকে ভাড়াটে বাসায় চলে আসে‌, ঘরদের পরিষ্কার করে রাখে। আমি বিকেলবেলা যাই। তারপর সোমবারে আমি অফিসে চলে যাবার পর‌, সে বাড়িতে তালা দিয়ে নিজের বাসায় ফিরে যায়। হাপ্তার বাকি দিন বাড়ি বন্ধ থাকে।’

প্রশ্ন : টেলিফোন রেখেছেন কেন?

উত্তর : নিজের জন্য নয়‌, সুকুমারীর জন্যে। সে যে-সময় ভাড়াটে বাড়িতে থাকে‌, সে-সময় নিজের বাসার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চায়। কিন্তু প্ৰাইভেট নম্বর‌, ডিরেকটরিতে পাবেন না।

প্রশ্ন : সেক্রেটারিকে নম্বর বলেননি?

উত্তর : না।

প্রশ্ন : কার জানা সম্ভব?

উত্তর : কারুর জানা সম্ভব নয়। আমি কাউকে বলিনি‌, সুকুমারীও কাউকে বলবে না।

প্রশ্ন : তাঁকে আপনি বিশ্বাস করেন?

উত্তর : করি। আমি তাকে মাসে হাজার টাকা দিই। সে নির্বোধ নয়‌, নিজের পায়ে কুডুল মারবে না।

প্রশ্ন; আজ যখন টেলিফোন পেলেন‌, তখন আপনি কি করছিলেন?

উত্তর : কীর্তন শুনছিলাম। সুকুমারী চণ্ডীদাসের পদ গাইছিল।

এ কে রে ব্যোমকেশের পানে চক্ষু ফিরাইলেন; ব্যোমকেশ নিঃশব্দে মাথা নাড়িল‌, অর্থাৎ‌, আর কোন প্রশ্ন নাই। তখন এ কে রে গাত্ৰোত্থান করিয়া বলিলেন‌, ‘আজ এই পর্যন্ত থাক। কষ্ট দিলাম‌, কিছু মনে করবেন না। আজ কি আপনি আবার–?’

‘না‌, ফিরে যাব না‌, বাড়িতেই থাকব।’ সন্তোষবাবুর গভীর চোখে কৌতুকের কটাক্ষ খেলিয়া গেল‌, তিনি বলিলেন‌, ‘আমার পিছনে গুপ্তচর লাগিয়ে আমার বাসার সন্ধান পাবেন না।’

এ কে রে জিভ কাটিয়া বলিলেন‌, ‘না না‌, সে কি কথা! আপনার গুপ্ত বাসা সম্বন্ধে আমার তিলমাত্র কৌতূহল নেই। আপনি যা বললেন‌, আমাদের তদন্তের পক্ষে তাই যথেষ্ট। কেবল-শ্ৰীমতী সুকুমারীর সঙ্গে একবার দেখা করতে পারলে ভাল হত।’

‘তাকে তার বাসার ঠিকানায় পাবেন।’ সন্তোষবাবু সুকুমারীর ঠিকানা দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন‌, ‘দশটা বাজে। আপনার কাজ বোধহয় এখনো শেষ হয়নি‌, যতক্ষণ দরকার থাকুন।। ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনি আমার পক্ষ থেকে ইন্সপেক্টরের সঙ্গে থাকবেন তো?’

‘নিশ্চয়’ বলিয়া ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল।

সন্তোষবাবু বলিলেন‌, ‘আচ্ছা‌, আমি তাহলে বিশ্রাম করি গিয়ে। একটু ক্লান্তি বোধ হচ্ছে।’

তিনি দৃঢ়পদে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। তাঁহার শরীরে ক্লান্তির কোন লক্ষণ চোখে পড়িল না। বোধহয় মনের ক্লান্তি। বাড়িতে এতবড় একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়া যাইবার পর–

সন্তোষবাবু যেভাবে তাঁহার গুপ্তকথা প্রকাশ করিলেন তাহাতে ঢাকাঢাকা গুড়গুড় নাই‌, নিজের সম্বন্ধে সাফাই গাঁহিবার চেষ্টা নাই—জীবনের গৃঢ় সত্য কথা যখন বলিতেই হইবে তখন স্পষ্টভাবে বলাই ভাল। তবু তাঁহার নির্মম সত্যবাদিতা আমার মনকে পীড়া না দিয়া পারিল না। তিনি পাকা ব্যবসায়ী এবং ঝানু রাজনীতিজ্ঞ‌, তাঁহার চরিত্রে এই কালো দাগটা না থাকিলেই বোধহয় ভাল হইত।

এ কে রে ব্যোমকেশকে প্রশ্ন করিলেন‌, ‘অতঃপর?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘চল‌, হেনার ঘরটা একবার দেখে যাই।’

‘চল।–ছাদে যাবে নাকি?’

‘যাব। এসেছি। যখন‌, যা-যা দ্রষ্টব্য আছে সবই দেখে যাই।’

হল-ঘরের গোল টেবিলের কাছে বসিয়া পুলিসের বাকি কর্মচারীরা নিম্নস্বরে বাক্যালাপ করিতেছিলেন‌, রবিবর্মা ছাড়া বাড়ির লোক আর কেহ উপস্থিত ছিল না। হেনীর ঘর ডাইনিং-রুম হইতে কোনাকুনিভাবে হল-ঘরের অপর প্রান্তে। [প্ল্যান পশ্য]। হেনার ঘরের দ্বার ঈষৎ উন্মুক্ত‌, আলো জ্বলিতেছে। আমরা তিনজনে ঘরে প্রবেশ করিলাম। রবিবর্মা আমাদের পিছন পিছন আসিল।

ঘরটি বেশ বড়। সদরের দিকে ধনুরাকৃতি বড় জানালা‌, পূর্বদিকের দেয়ালেও একটি সাধারণ জানালা আছে। এই জানালার সামনে টেবিল ও চেয়ার‌, পাশে বইয়ের শেলফ। ঘরের অন্য পাশে সংকীর্ণ একহারা খাটের উপর বিছানা পাতা; খাটের নীচে বড় বড় দু’টি সুটকেস দেখা যাইতেছে। উত্তরদিকের দেয়ালের কোণে একটি সরু দরজা সংলগ্ন বাথরুমের সহিত সংযোগ স্থাপন করিয়াছে। ঘরে আসবাবের বাহুল্য নাই‌, তাই ঘরটি বেশ পরিচ্ছন্ন দেখাইতেছে। সম্ভবত হেনাও পরিচ্ছন্ন স্বভাবের মেয়ে ছিল।

0 Shares