ঘরের মাঝখানে দাঁড়াইয়া চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিতে করিতে ব্যোমকেশ বলিল, ‘ঘরের দরজা কি খোলা ছিল?’
এ কে রে বলিলেন, ‘না, তালা লাগানো ছিল। মৃতদেহের হাতে একটা চামড়ার হ্যান্ড-ব্যাগ ছিল, তার মধ্যে চাবির রিঙ পাওয়া গেছে। এই যে।’ তিনি পকেট হইতে একটি চাবির গোছা বাহির করিয়া দিলেন।
চাবি হাতে লইয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘হেনা তাহলে ঘরে তালা দিয়ে ছাদে গিয়েছিল।’
এ কে রে বলিলেন, ‘তাই তো দেখা যাচ্ছে।’
রবিবর্মা মুখের সামনে মুষ্টি রাখিয়া কাশির মত একটা শব্দ করিল। ব্যোমকেশ তাহার দিকে চক্ষু ফিরাইলে সে বলিল, ‘হেনা দোর খুলে রেখে ঘর থেকে কখনো এক পা বেরুতো না, যখনি বেরুতে দোরে তালা দিয়ে বেরুতো।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাই নাকি? গোড়া থেকেই এই রকম, না, কোন উপলক্ষ হয়েছিল?’
‘গোড়া থেকেই এই রকম।’
ব্যোমকেশ আর কিছু বলিল না, চাবির রিঙ পর্যবেক্ষণ করিয়া বলিল, ‘পাঁচটা চাবি রয়েছে দেখছি। একটা তো দোরের তালার চাবি। আর অন্যগুলো?’
এ কে রে বলিলেন, ‘বাকিগুলোর মধ্যে দুটো হচ্ছে সুটকেসের চাবি। অন্য দুটো কোথাকার চাবি জানা গেল না।’
ব্যোমকেশ চাবিগুলি একে একে পরীক্ষা করিয়া বলিল, ‘একটা চাবিতে নম্বর খোদাই করা রয়েছে-৭ নম্বর। দেখ তো, এ চাবিটা কোথাও লাগে কি না।’
এ কে রে চাবিটি দেখিয়া বলিলেন, ‘না। যে চাবি দুটোর তালা পাওয়া যাচ্ছে না, এটা তারই একটা।’
‘টেবিলের দেরাজে। গা-তালা নেই?’
‘আছে। কিন্তু দেরাজগুলো সব খোলা। চাবি নেই।’
‘হুঁ।–কি মনে হয়?’
দু’জনে চোখে চোখে ক্ষণেক চাহিয়া রহিল, শেষে এ কে রে বলিলেন, ‘বলা শক্ত। অনেক সময় দেখা যায়। তালা হারিয়ে গেছে, কিন্তু চাবিটা রিঙে রয়ে গেছে।’
ব্যোমকেশ রবিবর্মার দিকে চাহিয়া বলিল, ‘আপনি কিছু বলতে পারেন?’
রবিবাম ঘাড় নাড়িল, ‘এ-ঘরের ভিতরের কথা আমি কিছু বলতে পারি না। এই প্রথম ঘরে ঢুকলাম।’
ব্যোমকেশ গলার মধ্যে শব্দ করিল, চাবির গোছা এ কে রে-কে ফেরৎ দিয়া টেবিলের সামনে গিয়া দাঁড়াইল।
একদিকে দেরাজযুক্ত টেবিল, লাল বনাত দিয়া ঢাকা, তাহার উপর দু-একটি বই ছাড়া আর কিছু নাই। তারপর চোখে পড়িল লাল বানাতের উপর একটি লাল গোলাপফুল পড়িয়া আছে। ঘরে ফুলদানি নাই, গোলাপফুলটা এমন অনাদৃতভাবে পড়িয়া আছে যে, আশ্চর্য লাগে।
ব্যোমকেশ ফুলটিকে স্পর্শ করিল না, সম্মুখে ঝুকিয়া সেটি ভালভাবে দেখিল, তারপর টেবিলের শিয়রে খোলা জানালার দিকে চোখ তুলিয়া বলিল, ‘তাজা ফুল। বাগানে গোলাপফুল আছে?’ জানালার বহিভাগের দৃশ্য অন্ধকারে দেখা যাইতেছিল না।
রবিবর্মা বলিল, ‘আছে।’
ব্যোমকেশ এ কে রে-কে বলিল, ‘গোলাপটা দেখে কী মনে হয়? এমনভাবে টেবিলের ওপর পড়ে আছে কেন?’
এ কে রে নীরবে জানালার বাহিরে অঙ্গুলি নির্দেশ করিলেন।
ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িয়া সায় দিল, ‘আমারও তাই মনে হচ্ছে। হেনা যখন ঘরে ছিল না, সেই সময় কেউ বাগান থেকে ফুলটা তুলে জানালার গরাদের ফাঁকে টেবিলের ওপর ফেলে দিয়েছে।’ আমাদের সকলের চক্ষু রবিবর্মার দিকে ফিরিল, সকলের চোখে একই প্রশ্ন-কে ফেলতে পারে?
রবিবর্মা কিন্তু আমাদের জিজ্ঞাসু চক্ষু এড়াইয়া এদিকে-ওদিকে চাহিতে লাগিল, শেষে বলিল, ‘আমি কিছু জানি না।’
ব্যোমকেশ নিশ্বাস ফেলিয়া দেরাজগুলি খুলিয়া খুলিয়া দেখিতে লাগিল, আমি বইয়ের শেলফের সামনে গিয়া দাঁড়াইলাম।
দু-সারি বই। প্রথম সারিতে রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা, সত্যেন দত্তের কাব্যসঞ্চয়ন, নজরুলের সঞ্চিতা এবং আধুনিক লেখকদের রচিত কয়েকটি কথােকাহিনীর পুস্তক। দ্বিতীয় সারিতে অনেকগুলি ইংরেজি উপন্যাসের সুলভ সংস্করণ। হেনা বিদেশী রহস্য-রোমাঞ্চের বইও পড়িত।
‘অজিত, দ্যাখো।’
আমি ফিরিয়া দেখিলাম, ব্যোমকেশ দেরাজ হইতে একটি ফটোগ্রাফ বাহির করিয়াছে এবং একদৃষ্টি তাহা দেখিতেছে। কার্ডবোর্ডের উপর আটা পোস্টকার্ড সাইজের ছবিতে কেবল একটি রমণীর প্রতিকৃতি! আমি এক নজর দেখিয়া বলিয়া উঠিলাম, ‘হেনার ফটো।’
ব্যোমকেশ মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘না। ছবিটা কয়েক বছরের পুরনো, দেখছি না হলদে হয়ে গেছে, অথচ মহিলাটির বয়স পঁচিশের কম নয়। হেনা হতে পারে না, বোধহয় হেনার মা। হেনা এত রূপ কোথা থেকে পেয়েছিল বোঝা যাচ্ছে।’
হেনাকে জীবিত অবস্থায় দেখি নাই, মৃতদেহ দেখিয়া রূপ অনুমান করিয়াছিলাম। এখন এই ফটো দেখিয়া মনে হইল, হেনাকে জীবন্ত অবস্থায় দেখিতেছি। শুধু রূপ নয়, অফুরন্ত প্রাণশক্তি সর্বাঙ্গ দিয়া বিছুরিত হইতেছে।
ব্যোমকেশ ছবিটা এ কে রে-র হাতে দিয়া বলিল, ‘এটা রাখো। সন্তোষবাবুকে জিজ্ঞেস করতে হবে ছবিটা হেনার মায়ের কিনা।’
এ কে রে ছবিটি লইয়া চোখ বুলইলেন, রবিবর্মা গলা বাড়াইয়া দেখিয়া লইল। লোকটির চোখ-মুখ দেখিয়া কিছু বোঝা যায় না, কিন্তু প্ৰাণে যথেষ্ট কৌতূহল আছে।
এ কে রে ফটো পকেটে রাখিলেন, বলিলেন, ‘আচ্ছা। দেরাজে আর কিছু পেলে?’
না। খুচরো দু-চারটে পয়সা আছে; এমন কিছু নেই। রবিবাবু্, হেনার নামে চিঠিপত্র আসত কিনা। আপনি জানেন?’
রবিবর্মা বলিল, ‘চিঠি আসার সময় আমি বাড়িতে থাকি না। নেংটি কিংবা চিংড়ি বলতে পারে।’
আর কিছু না বলিয়া ব্যোমকেশ বইয়ের শেলফের কাছে আসিল, বইগুলির মলাটের উপর একবার চোখ বুলাইয়া সঞ্চয়িতা বইখানি হাতে লইল। মলাট খুলিতেই দেখা গেল, এক টুকরা গোলাপী কাগজ ভাঁজের মধ্যে রহিয়াছে। কাগজের উপর চার ছত্র হাতের লেখা! ব্যোমকেশ কাগজটি দু’ আঙুলে তুলিয়া ধরিয়া দেখিতেছে, রবিবর্মা বকের মত সেদিকে গলা বাড়াইল। ব্যোমকেশ কিন্তু তাহাকে লেখাটি পড়িতে দিল না, চট্ করিয়া কাগজ পকেটে পুরিল। রবিবর্মার মুখে ভাবোস্তর হইল না বটে, কিন্তু তাহার প্রাণটা যে ঐ লেখাটি পড়িবার জন্য আকুলি-বিকুলি করিতেছে, তাহা অনুমান করা শক্ত হইল না।