মণিমণ্ডন

‘হঠাৎ ঘুম ভাঙল মণির ডাকে। ও আমার বিছানার ওপর ঝুকে ডাকছে‌, ‘বাবা! বাবা? আমি ধড়মড়িয়ে উঠে বললাম‌, ‘কী রে? মণি বলল‌, ‘নেকলেসটা কোথায় রেখেছেন?’ আমি বললাম‌, ‘টেবিলের দেরাজে। কেন?’ ও বলল‌, ‘কই‌, সেখানে তো নেই।’

‘আমি ছুটে গিয়ে দেরাজ খুললাম। নেকলেসের বাক্স নেই। সব দেরাজ হাঁটকালাম। কোথাও নেই। মনের অবস্থা বুঝতেই পারছেন। মণিকে জিজ্ঞেস করলাম‌, ‘তুই এত রাত্রে কী করে জানলি?’ সে বলল–’

ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া রসময়কে নিবারণ করিল‌, মণিময়ের দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিল‌, ‘রাত্রি তখন ক’টা?’

মণিময় অত্যন্ত সঙ্কুচিত হইয়া বলিল‌, ‘প্রায় বারটা। বারটা বাজতে পাঁচ মিনিট কি দশ মিনিট হবে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘রাত বারটার সময় কোনও কারণে আপনার সন্দেহ হয়েছিল যে‌, নেকলেস চুরি গেছে। কী করে সন্দেহ হল সব কথা খুলে বলুন।’

মণিময় যেন আরও সঙ্কুচিত হইয়া পড়িল‌, পিতার প্রতি একটি গুপ্ত কটাক্ষপাত করিয়া ঈষৎ স্বলিত স্বরে বলিতে আরম্ভ করিল‌, ‘কাল আমার ক্লাব থেকে ফিরতে একটু বেশি দেরি হয়ে গিয়েছিল। ক্লাবে ব্রিজ-ড্রাইভ চলছে‌, আমি-’

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘কোথায় ক্লাব? নাম কী?’

‘ক্লাবের নাম-খেলাধুলো। খুব কাছেই‌, আমাদের বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের রাস্তা। সব রকম ঘরোয়া খেলার ব্যবস্থা আছে‌, তাস পাশা পিংপং বিলিয়ার্ড। কাল ব্রিজ-ড্রাইভ শেষ হতে রাত হয়ে গেল–’

‘আপনি হেঁটে ক্লাবে যান?’

‘আজেজ্ঞ হ্যাঁ‌, খুব কাছে‌, তাই হেঁটেই যাই। কাল যখন ক্লাব থেকে বেরুলাম তখন পোনে বারটা। রাত নিযুতি। আমাদের বাড়ির সদর দরজার ঠিক সামনে একটা ল্যাম্পপোস্ট আছে। আমি যখন বাড়ির প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ গজের মধ্যে এসেছি তখন দেখলাম‌, আশেপাশের দোকান সব বন্ধ হয়ে গেছে‌, কিন্তু একটা লোক ঠিক আমাদের দোরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা বোধ হয় আমার পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েছিল‌, ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল‌, তারপর চট্ট করে বাড়িতে ঢুকে পড়ল।

‘দূর থেকে দেখে মনে হল‌, ভোলা চাকর। কাছে এসে দেখলাম দরজা ভেজানো রয়েছে। অন্যদিন আমি দশটা সাড়ে দশটার মধ্যে বাড়ি ফিরি‌, কিন্তু সদর দরজা তার আগেই বন্ধ হয়ে যায়। আজ খোলা রয়েছে। আমার খটকা লাগল। সদর দরজায় হুড়কো লাগিয়ে ওপরে উঠে গেলাম। দোতলায় চাকরেরা ঘুমোচ্ছে‌, কারুর সাড়া শব্দ নেই।

‘তোতলায় উঠতেই স্ত্রী এসে দরজা খুলে দিলেন। আপনি বোধ হয় লক্ষ্য করেছেন‌, তেতলার দরজায় বিলাতি গা-তালা লাগানো; ভিতর থেকে বন্ধ করে দিলে বিনা চাবিতে বাইরে থেকে খোলা যায় না। আমি স্ত্রীকে বললাম‌, বাড়ির সামনে একটা লোক দাঁড়িয়ে ছিল। উনি বললেন‌, উনিও দেখেছেন—’

‘উনিও দেখেছেন?’ ব্যোমকেশ বধূর পানে চোখ ফিরাইল।

বধূ লজ্জা পাইল‌, তাহার মুখ উত্তপ্ত হইয়া উঠিল। রসময় তাহাকে উৎসাহ দিয়া বলিলেন‌, ‘লজ্জা কী বোমা? যা দেখেছ ব্যোমকেশকে বল।’

বধূ তখন লজ-স্তিমিত কণ্ঠে থামিয়া থামিয়া বলিল‌, ‘কাল রাত্তিরে—আমি—ওঁর ক্লাব থেকে ফিরতে দেরি হচ্ছিল—আমি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলুম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর—হঠাৎ দেখলুম‌, ঠিক আমাদের দরজার সামনে ফুটপাথের ওপর কে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি বুকে দেখবার চেষ্টা করলুম‌, কিন্তু ভাল দেখতে পেলুম না। তারপরেই লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেল। মনে হল দরজায় ঢুকে পড়ল। সেই সময় দেখতে পেলুম উনি আসছেন‌, লোকটা যেন ওঁকে দেখেই ভেতরে ঢুকে পড়ল। তারপর আমি গিয়ে তেতলার দরজা খুলে দিলুম। উনি এলেন।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘লোকটাকে চিনতে পেরেছিলেন?’

বধূ মাথা নাড়িল‌, ‘না‌, ওপর থেকে তার মুখ দেখা যাচ্ছিল না। তবে মনে হয়েছিল‌, চাকরদের মধ্যেই কেউ হবে।’

‘হুঁ, ব্যোমকেশ মণিময়কে বলিল‌, ‘তারপর কী হল?’

মণিময় বলিল‌, ‘স্ত্রীর কথা শুনে সন্দেহ আরও বেড়ে গেল। নেকলেসটা বিকেলবেলা এনেছি‌, সেটা বাবা নিশ্চয় টেবিলের দেরাজে রেখেছেন‌, কারণ সিন্দুকের চাবি নিয়ে মা চলে গেছেন। আমি চুপি চুপি বাবার অফিস-ঘরে গেলাম। আলো জ্বেলে দেরাজগুলো খুলে দেখলাম। নেকলেসের কেস নেই। আরও যেখানে যেখানে রাখা সম্ভব সব জায়গায় খুঁজলাম। কোথাও নেই। ভীষণ ভয় হল। তখন বাবাকে ডেকে তুললাম।’

মণিময় চুপ করিলে ব্যোমকেশ নিবিষ্ট মনে আর একটি সিগারেট ধরাইল‌, তারপর সপ্রশ্ন চক্ষে রসময়ের পানে চাহিল। রসময় আবার কাহিনীর সূত্র তুলিয়া লইলেন–

‘যখন নিঃসংশয়ে বুঝলাম নেকলেস চুরি গেছে তখন সব সন্দেহ পড়ল ভোলার ওপর। ভেবে দেখুন‌, আমার তেতলার সদর দরজায় ইয়েল লক লাগানো; ভেতর থেকে বাইরে যাওয়া সহজ‌, কিন্তু বাইরে থেকে ভেতরে আসা সহজ নয়। রাত্রি দশটার পর চাকরীদের মধ্যে একমাত্র ভোলাই ভেতরে ছিল। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম‌, ভোলা কখন উঠে গেছে জানি না। হয়তো সে পৌঁনে বারটার সময় উঠে গেছে‌, দেরাজ থেকে নেকলেস নিয়ে চুপি চুপি বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেছে। নিচে হয়তো তার ষাড়ের লোক ছিল-‘

ব্যোমকেশ মণিময়কে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘আপনি একটা লোকই দেখেছিলেন?’

মণিময় বলিল‌, ‘হ্যাঁ। দ্বিতীয় জনপ্ৰাণী সেখানে ছিল না।’

ব্যোমকেশ বধূর দিকে ফিরিয়া বলিল‌, ‘আপনি?’

বধূ বলিল‌, ‘আমিও একজনকেই দেখেছিলুম। আমি সারাক্ষণ নিচের দিকেই তাকিয়ে ছিলুম‌, আর কেউ থাকলে দেখতে পেতুম।’

ব্যোমকেশ কিয়াৎকাল সিগারেট টানিল‌, শেষে রসময়কে বলিল‌, ‘তারপর আপনি কী করলেন?’

রসময় বলিলেন‌, তখন বারটা বেজে গেছে। বাপ-বেটীয় পরামর্শ করে থানায় টেলিফোন করলাম। মণি নিচে নেমে গিয়ে সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল‌, যাতে বাড়ি থেকে কেউ বেরুতে না পারে। থানার বড় দারোগা অমরেশবাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে‌, বিশিষ্ট ভদ্রলোক। ভাগ্যক্রমে তিনি থানায় উপস্থিত ছিলেন‌, ফোন পেয়ে তক্ষুনি তিন-চারজন লোক নিয়ে এসে পড়লেন।

0 Shares