‘প্রথমে দোতলার ঘরগুলো খানাতল্লাশ হল। চাকরেরা সকলেই ঘুমোচ্ছিল ভোলাও ছিল। পুলিস তন্নতন্ন করে তল্লাশ করল, কিন্তু নেকলেস পাওয়া গেল না।
‘অমরেশবাবু তখন তেতলা খানাতল্লাশ করলেন। বলা যায় না, চোর হয়তো নেকলেস চুরি করে এখানেই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। পরে তাক বুঝে সরাবে। কিন্তু এখানেও নেকলেস পাওয়া গেল না।
‘অমরেশবাবু তারপর ভোলাকে জেরা আরম্ভ করলেন। ভোলা স্বীকার করল, সে নিচে নেমে গিয়েছিল। সে বলল, আন্দাজ এগারটার সময় আমি ঘুমিয়ে পড়েছি দেখে সে দোতলায় নেমে যায়। অন্য চাকরেরা তখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। ভোলাও শুয়ে পড়ল, কিন্তু তার ঘুম এল না। তখন সে খোলা হাওয়ার খোঁজে নিচে গিয়ে ফুটপাথে দাঁড়াল। মণিময় যে ক্লাব থেকে ফেরেনি তা সে জানত না। সে ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেল মণি আসছে। তখন সে তাড়াতাড়ি ফিরে এসে আবার শুয়ে পড়ল কারণ রাত্তিরে চাকর-বাকরের বাইরে যাওয়ার কড়া বারণ আছে। এই তার বয়ান। নেকলেসের কথা সে জানে না।
‘অমরেশবাবুর জেরায় আরও জানা গেল, ভোলার দুই ভাই কলকাতায় থাকে, মেছুয়াবাজারে তাদের বাসা। ভায়েদের সঙ্গে ভোলার বিশেষ দহরম-মহরম নেই, তবে হাতে কাজ না থাকলে মাঝে মাঝে তাদের বাসায় দেখা করতে যায়।
‘অমরেশবাবু যতক্ষণ ভোলাকে সওয়াল জবাব করছিলেন ততক্ষণ তাঁর সঙ্গীরা রাস্তার দু’ পাশে তল্লাশ করছিল; আনোচ কানাচ ডাস্টবিন সব খুঁজে দেখছিল। মণিও তাদের সঙ্গে ছিল। কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না। এইসব ব্যাপারে ভোর হয়ে গেল, অমরেশবাবু দোতলায় একজন লোক রেখে চলে গেলেন। ভোলাকে বলে গেলেন, এ-বাড়ি থেকে বেরুবার চেষ্টা করলেই গ্রেপ্তার করা হবে।
‘তারপর–তারপর যত বেলা বাড়তে লাগল ততাই আমার মন অস্থির হয়ে উঠল। অমরেশবাবু কাজের লোক, চেষ্টার ত্রুটি করবেন না। কিন্তু আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না ব্যোমকেশবাবু। আপনাকে ফোন করলাম। আপনি আমার নেকলেস উদ্ধার করে দিন। আপনি ছাড়া এ-কাজ আর কেউ পারবে না।’
ব্যোমকেশ একটু হাসিল, ‘আমার ওপর আপনার এত বিশ্বাস, আশা করি বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারব! —ভোলা চাকর তো বাড়িতেই আছে?’
‘হ্যাঁ, দোতলার ঘরে আছে।’
‘তাকে একবার ডেকে পাঠালে দু-চারটে প্রশ্ন করে দেখতাম।’
‘বেশ তো।’ রসময় পুত্রের দিকে চাহিলেন।
মণিময় চলিয়া গেল এবং কিছুক্ষণ পরে ভোলাকে লইয়া ফিরিয়া আসিল।
ভোলা চাকরের চেহারা সাধারণ ভৃত্য শ্রেণীর লোকের চেহারা হইতে পৃথক নয়। একজাতীয় মুখ আছে যাহা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীর্ণ ও অস্থিসার হইয়া পড়ে, উচু নাক ও ছুচলো চিবুক প্রাধান্য লাভ করে। ভোলার মুখ সেই জাতীয়। দেহও বেউড় বাঁশের মত পাকানো; বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। তাহার চোখের দৃষ্টিতে ভয়ের চিহ্ন নাই, কিন্তু সংযত সতর্কতা আছে।
ব্যোমকেশ তাহাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, ‘তোমাকে দু-একটা প্রশ্ন করতে চাই।’
ভোলা সহজভাবে বলিল, ‘আজ্ঞে।’
‘নাম কী?’
‘ভোলানাথ দাস।’
‘দেশ কোথায়?
‘মেদিনীপুর জেলায়।’
‘কলকাতায় কতদিন আছ?’
‘তা পনর বছর হবে।’
‘তোমার দুই ভাই কলকাতায় থাকে?’
‘আজোব হ্যাঁ, মেছোবাজারে বাসা নিয়ে একসঙ্গে থাকে।’
‘তুমি ভায়েদের সঙ্গে থাক না?’
‘আজ্ঞে, আমি যেখানে চাকরি করি সেখানেই থাকি।’
‘ভায়েদের সঙ্গে বনিবনাও আছে?’
‘আজ্ঞে, বে-বনিবনাও নেই। তবে দাদারা লেখাপড়া জানা লোক। আমি মুখখু
‘তোমার দাদারা কী কাজ করে?’
‘বড়দা পোস্ট-অফিসে কাজ করে, মেজদা কপোরেশনের জমাদার।’
‘তুমি বিয়ে করনি?’
‘করেছিলাম, বৌ মরে গেছে।’
‘এ-বাড়িতে কতদিন কাজ করছি?’
‘দেড় বছর।’
‘তার আগে কোথায় কাজ করেছ?’
‘অনেক জায়গায় কাজ করেছি।’
‘কী কাজ?
‘আজেরি, পা-টেপ চাকরের কাজ। অন্য কাজ করবার বিদ্যে আমার নেই।’
বিদ্যা না থাক, বুদ্ধি যথেষ্ট আছে সে-বিষয়ে সন্দেহ নাই। যে-বুদ্ধি নিজেকে প্রচ্ছন্ন করিয়া রাখিতে পারে, সেই বুদ্ধি। ব্যোমকেশ আবার আরম্ভ করিল, ‘সকলে সন্দেহ করেন তুমিই হীরের নেকলেস চুরি করেছ।’
‘কাল যখন মণিময়বাবু নেকলেসের বাক্স এনে রসময়বাবুকে দেন, তখন তুমি তাঁর পায়ে মালিশ করে দিচ্ছিলে।’
‘একটা বাক্স এনে দিয়েছিলেন। বাক্সে কী আছে আমি জানতাম না।’
‘কিছু আন্দাজ করতে পারনি? রসময়বাবু যখন বাক্স খোলবার আগে তোমাকে চলে যেতে বললেন তখনও কিছু আন্দাজ করনি?’
‘আজ্ঞে না।’
ব্যোমকেশ ক্ষণেক ভ্রূকুটি করিয়া নীরব রহিল, তারপর সহসা চক্ষু তুলিয়া বলিল, ‘কাল সন্ধ্যের পর তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলে?’
এতক্ষণে ভোলার চোখে একটু উদ্বেগের চিহ্ন দেখা দিল, কিন্তু সে সহজ সুরেই বলিল, ‘আজ্ঞে, বেরিয়েছিলাম। একটা গামছা কেনবার ছিল, তাই বৌদিদির কাছে ছুটি নিয়ে বেরিয়েছিলাম।’
ব্যোমকেশ বধূর দিকে চাহিল, বধূ ঘাড় হেলাইয়া সায় দিল। রসময়বাবুর মুখ দেখিয়া মনে হইল, তিনি এ-খবর জানিতেন না। মণিময়ও জানিত না, কারণ সে তৎপূর্বেই ক্লাবে চলিয়া গিয়াছিল। কিন্তু ব্যোমকেশ জানিল কী করিয়া? অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়িয়াছে?
সে ভোলাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কতক্ষণ বাইরে ছিলে?’
‘ঘণ্টাখানেক।’
‘গামছা কিনতে এক ঘণ্টা লাগল?’
‘আজ্ঞে, গামছা কিনে খানিক এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়েছিলাম।’
‘কারুর সঙ্গে দেখা করনি?’
‘আজ্ঞে, না।’
‘তোমার বন্ধুবান্ধব কেউ নেই?
‘চেনাশোনা দু-চারজন আছে, বন্ধু নেই।’
‘যাক।–কাল রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর তুমি রসময়বাবুর পা টিপে দিয়েছিলে?’