মণিমণ্ডন

‘আজ্ঞে। রোজ টিপে দিই।’

‘কাল ক’টা অবধি পা টিপে দিয়েছিলে?’

‘ঘড়ি দেখিনি। আন্দাজ এগারটা হবে।’

‘তুমি যখন দোতলায় নেমে গেলে‌, অন্য চাকরেরা জেগে ছিল?’

‘আজ্ঞে না‌, ঘুমিয়ে পড়েছিল।’

‘কেউ জেগে ছিল না?’

‘কেউ না।’

‘ভারী আশ্চর্য। যাহোক‌, তুমি তারপর কী করলে? শুয়ে পড়লে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘তবে রাত বারটার সময় রাস্তায় বেরিয়েছিলে কেন?’

‘অনেকক্ষণ শুয়ে শুয়ে ঘুম এল না‌, তখন নিচে নেমে গেলাম। ভেবেছিলাম‌, খোলা জায়গায় খানিক দাঁড়ালে ঘুম আসবে।’

‘কতক্ষণ ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ছিলে?

‘দু-তিন মিনিটের বেশি নয়। দাদাবাবু যে কেলাব থেকে ফেরেননি তা জানতাম না। দেখলাম। তিনি আসছেন‌, তাই তাড়াতাড়ি চলে এলাম।’

‘সিঁড়ির দরজা বন্ধ করেছিলে?’

‘আজ্ঞে‌, দাদাবাবু আসছেন‌, তাই বন্ধ করিনি।’

ব্যোমকেশ আর একবার ভোলার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিল‌, বোধ করি মনে মনে তাহার স্থিরবুদ্ধির প্রশংসা করিল‌, তারপর শুষ্কম্বরে বলিল‌, ‘আচ্ছা‌, তুমি এখন যেতে পার।’

ভোলা চলিয়া গেল। সদর দরজা বন্ধ করার আওয়াজ আসিলে রসময় জিজ্ঞাসুনেত্রে ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন‌, ‘কী মনে হল?’

ব্যোমকেশ বিমৰ্ষভাবে বলিল‌, ‘ভারী হুঁশিয়ার লোক। তবে কাল সন্ধ্যেবেলা যে বেরিয়েছিল‌, তা স্বীকার করেছে।’

‘তাতে কী প্রমাণ হয়?’

‘প্রমাণ কিছুই হয় না। তবে ওর যদি কেউ ষাড়ের লোক থাকে‌, চুরির আগে তার সঙ্গে নিশ্চয় দেশৃঙ্খল। নইলে নেকলেসটা লোপাট হয়ে গেল কী করে?’

‘তা বটে।’

ভোলা সম্বন্ধে আর বেশি আলোচনা হইতে পাইল না‌, দ্বারে টোকা পড়ায় মণিময় চলিয়া গেল। এবং অবিলম্বে পুলিস দারোগার পোশাক-পরা এক ভদ্রলোককে লইয়া উপস্থিত হইল। লম্বা চওড়া চেহারা‌, ব্যক্তিত্রবান পুরুষ। দারোগা অমরেশবাবু সন্দেহ নাই।

রসময় উঠিবার উপক্রম করিয়া সবিনয়ে বলিলেন‌, ‘এ কী অমরেশবাবু্‌, কী খবর! আপনি আবার এলেন যে!’

ভায়েদের বাসা খানাতল্লাশ করতে। কিন্তু–’ এই সময় আমাদের উপর নজর পড়ায় তিনি থামিয়া গেলেন।

রসময়বাবু অপ্রতিভভাবে পরিচয় করাইয়া দিলেন‌, ‘ইন্সপেক্টর মণ্ডল‌, ইনি— ইয়েব্যোমকেশ বক্সী। বোধ হয় নাম শুনেছেন।’

অমরেশবাবু খাড়া হইয়া বসিলেন‌, বিস্ময়োৎফুল্প স্বরে বলিলেন‌, ‘বিলক্ষণ! ব্যোমকেশ বক্সীর নাম কে না শুনেছে? আপনিই! আপনার নাম প্রমোদ বরাটের কাছেও শুনেছি‌, মশাই। প্রমোদকে মনে আছে? গোলাপ কলোনীর ব্যাপারে তদন্ত করেছিল। প্রমোদ আমার বন্ধু।’

ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল‌, ‘প্রমোদীবাবুকে খুব মনে আছে। ভারী বুদ্ধিমান লোক।’

অমরেশবাবু বলিলেন‌, ‘সে আপনার পরম ভক্ত। তার আছে আপনার অদ্ভূত ক্ষমতার গল্প শুনেছি।–তা আপনিও এই নেকলেস চুরির ব্যাপারে আছেন নাকি? বেশ বেশ‌, আপনাকে পাওয়া তো ভাগ্যের কথা; প্রমোদের মুখে শুনেছি আপনার খ্যাতির লোভ নেই‌, কেবল সত্যান্বেষণ করেই আপনি সন্তুষ্ট। হা হা।’

ব্যোমকেশ মুখ টিপিয়া হাসিল‌, ইন্সপেক্টর মণ্ডল‌, যার যা আছে সে তা চায় না‌, এই প্রকৃতির নিয়ম। এ-ব্যাপারে খ্যাতি যদি কিছু প্রাপ্য হয় আপনিই পাবেন। আমি মজুরি পেলেই সন্তুষ্ট হব।’

রসময়বাবু গাঢ়স্বরে বলিলেন‌, ‘মজুরি বলবেন না‌, ব্যোমকেশবাবু্‌, সম্মান-দক্ষিণা। যদি আমার নেকলেস ফিরে পাই‌, আপনার সম্মান রাখতে আমি ত্রুটি করব না।’

‘সে যাক‌, ব্যোমকেশ আমরেশবাবুর দিকে ফিরিল‌, ‘আপনি ভোলার ভায়েদের বাসা সার্চ করেছেন‌, কিন্তু কিছু পেলেন না?’

অমরেশবাবু বলিলেন‌, ‘কিছু পেলাম না। ওর ভায়েরা কাজে বেরিয়েছিল। দুই বৌ ঘরে ছিল। কিন্তু অতিপতি করে খুঁজেও কিছু পাওয়া পাওয়া গেল না।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ তাঁহার পানে চাহিয়া বলিল‌, ‘তাহলে আপনার সন্দেহ ভোলা তার ভায়েদের সঙ্গে ষড় করে একাজ করেছে।’

নইলে নেকলেসটা লোপাট হয়ে গেল কী করে?

‘মণিময়বাবু এবং তাঁর স্ত্রী কিন্তু অন্য লোক দেখেননি।’

‘ওঁরা যখন ভোলাকে দেখেছেন‌, তার আগেই হয়তো ষাঁড়ের লোক মাল নিয়ে সরে পড়েছে।’

‘মণিময়বাবুর স্ত্রী অনেকক্ষণ ধরে জানালায় দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ষাড়ের লোক এলে উনি তাকে দেখতে পেতেন না কি?’

দুইজনে কিছুক্ষণ পরস্পরের পানে চাহিয়া রহিলেন‌, তারপর অমরেশবাবু দ্বিধাভরে প্রশ্ন করিলেন‌, ‘আপনার কি মনে হয় ভোলার কাজ নয়?’

‘এখন কিছু মনে হচ্ছে না। তত্ত্বতল্লাশ যা করবার সবই আপনি করেছেন‌, কিছুই বাকী রাখেননি। এখন শুধু ভেবে দেখতে হবে।’ সে উঠিয়া দাঁড়াইল‌, ‘এখন উঠি। যদি ভেবে কিছু পাওয়া যায় আপনাদের জানাব।’

বাসায় ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘তোমার সন্দেহটা কার ওপর?’

ব্যোমকেশ পাঞ্জাবি খুলিতে খুলিতে বলিল‌, ‘তিনজনের ওপর।’

চমকিয়া বলিলাম‌, ‘তিনজন করা?’

‘ভোলা‌, মণিময় এবং মণিময়ের স্ত্রী–’ বলিয়া ব্যোমকেশ স্নান করিতে চলিয়া গেল।

বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম। সুযোগের দিক দিয়া তিনজনকেই সন্দেহ করা যায়। রসময়ের দেরাজ হইতে নেকলেস সরানো তিনজনের পক্ষেই সম্ভব। আর মোটিভ? বড়মানুষের ছেলেদের সর্বদাই টাকার দরকার। মণিময় ক্লাবে গিয়া তাস-পাশা খেলে‌, নিশ্চয় বাজি রাখিয়া খেলে। হয়তো অনেক টাকা দেনা হইয়াছে‌, ভয়ে বাপের কাছে বলিতে পারিতেছে না।–’

আর মণিময়ের স্ত্রী? মেয়েটি দেখিতে শান্ত শিষ্ট‌, কিন্তু তাহার মুখের উদ্বেগের ব্যঞ্জনা প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে। গহনার প্রতি স্ত্রীজাতির লোভ অবস্থা বিশেষে দুৰ্নিবার হইয়া উঠিতে পারে।

কিন্তু যে-ই চুরি করুক‌, চোরাই মাল বেমালুম সরাইয়া ফেলিল কী করিয়া? সেদিন দুপুরবেলা ব্যোমকেশ আরাম-কেদারায় লম্বা হইয়া সারাক্ষণ কড়িকাঠের শোভা নিরীক্ষণ করিল‌, কথাবার্তা বলিল না। আপারান্ত্রিক চা পানের পর হঠাৎ বলিল‌, ‘চল‌, একবার ঘুরে আসা যাক।’

0 Shares