মণিমণ্ডন

একটি একটি করিয়া মিনিট কাটিতেছে। সঞ্চরমাণ মিনিটগুলির লঘু পদধ্বনি নিজের বক্ষ-স্পন্দনে শুনিতে পাইতেছি। …পাঁচটা বাজিল; শরীরের স্নায়ুপেশী শক্ত হইয়া উঠিল।

লোকটা কখন নিঃশব্দে ডাক-বাক্সের সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। যেন ভৌতিক আবির্ভাব। গায়ে খাকি পোশাক‌, কাঁধে দুটা বড় বড় ঝোলা! ঝোলা দুটা ফুটপাথে নামাইয়া সে পকেট হইতে চাবির গোছা বাহির করিল‌, তারপর ডাক-বাক্সের তালা খুলিতে প্রবৃত্ত হইল।

ব্যোমকেশ হাত নাড়িয়া ইশারা করিল‌, আমরা শিকারীর মত অগ্রসর হইলাম। গলির মুখ হইতে বাহির হইয়া দেখিলাম, রাস্তার দুই দিক হইতে আরও দুই জোড়া লোক আমাদেরই মত ডাক-বাক্সের দিকে অগ্রসর হইতেছে। নিঃসন্দেহে পুলিসের লোক‌, কিন্তু গায়ে ইউনিফর্ম নাই।

লোকটা ডাক-বাক্সের কবাট খুলিয়াছে‌, আমরা গিয়া তাহাকে ঘিরিয়া ধরিলাম। সে খোলা কবাট পিঠ দিয়া আড়াল করিয়া স্খলিত স্বরে বলিল‌, ‘কে‌, কী চাই?’

ব্যোমকেশ কড়া সুরে বলিল‌, ‘তোমার নাম ভূতনাথ দাস। তুমি ভোলার বড় ভাই!’

ভূতনাথ দাসের মুখখানা ভয়ে শীর্ণ-বিকৃত হইয়া গেল‌, চক্ষু দুটা ঠিকরাইয়া বাহির হইবার উপক্রম করিল। সে থারথার কম্পিত কণ্ঠে বলিল‌, ‘কে-কে আপনারা?’

অমরেশবাবু হুঙ্কার দিয়া বলিলেন‌, ‘আমরা পুলিস।’

অমরেশবাবু যে দলের মধ্যে আছেন তাহা প্রথম লক্ষ্য করিলাম। তিনি সামনে আসিয়া দৃঢ়ভাবে ভূতনাথের কাঁধে হাত রাখিলেন। অনুভব করিলাম‌, একটু নাটকীয় ভঙ্গীতে ভূতনাথকে ভয় পাওয়াইবার চেষ্টা হইতেছে। চেষ্টা ফলপ্রসূ হইল। ভূতনাথ একেবারে দিশহারা হইয়া গেল‌, হঠাৎ উগ্র তারস্বরে কাঁদিয়া উঠিল‌, ‘ওরে ভোলা‌, তুই আমার এ কী সর্বনাশ করলি রে! আমার চাকরি যাবে-আমি যে জেলে যাব রে।’

সে থামিতেই অমরেশবাবু তাহার কাঁধে একটা ঝাঁকানি দিয়া বলিলেন‌, ‘কোথায় রেখেছ চোরাই মাল‌, বের কর।’

ভূতনাথ অমরেশবাবুর পায়ের উপর উপুড় হইয়া পড়িল‌, ‘হুজুর‌, ও পাপ জিনিস। আমি ছুঁইনি। ডাক-বোক্সর মধ্যেই আছে।’

ক্ষণকাল স্তব্ধ হইয়া রহিলাম। পরশু মধ্যরাত্রি হইতে আজ সকাল পর্যন্ত নেকলেস রসময়বাবুর বাড়ির দেয়ালে-গাঁথা ডাক-বাক্সের মধ্যেই আছে।

অমরেশবাবু বলিলেন‌, ‘বের কর।’

ভূতনাথ উঠিয়া ডাক-বাক্সের দিকে ফিরিল। ডাক-বাক্সে অনেক চিঠি জমা হইয়াছিল‌, তাহার হাত ঢুকাইয়া বাক্সের পিছন দিকের কোণ হইতে একটি পার্সেল বাহির করিয়া আনিল। সাদা কাপড়ে সেলাই করা ব্ৰাউন ষোলপেজী বইয়ের মত আকার আয়তন। ভূতনাথ সেটি অমরেশবাবুর হাতে দিয়া কাতরস্বরে বলিল‌, ‘এই নিন বাবু। ধর্ম জানে এর ভেতর কী আছে‌, আমি চোখে দেখিনি।’

এই সময় রসময়ের সদর দরজা খুলিয়া গেল! লাঠিতে ভর দিয়া রসময় এবং তাঁহার পিছনে মণিময় ও বধূ। সকলের সদ্য-যুম-ভাঙা চোখে সবিস্ময় উদ্বেগ। রসময় বলিলেন‌, ‘অমরেশবাবু! ব্যোমকেশবাবু? কী হয়েছে? আমার নেকলেস–?’

ব্যোমকেশ অমরেশবাবুর হাত হইতে প্যাকেট লইয়া রসময়ের হাতে দিল, ‘এই নিন আপনার নেকলেস। খুলে দেখুন।’

বেলা আন্দাজ সাড়ে ন’টার সময় আমরা দু’জনে আমাদের বসিবার ঘরে চৌকির উপর মুখোমুখি উপবিষ্ট ছিলাম। সত্যবতীকে আর এক প্রস্থ চায়ের ফরমাশ দেওয়া হইয়াছে। নেকলেস-পর্বের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চলিতেছে।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘অনর্থক হয়রানি। ডাক-বাক্সটা দোরের পাশেই আছে। এটা যদি প্রথমে নজরে পড়ত তাহলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সব নিস্পত্তি হয়ে যেত। কলকাতা শহরে দেয়ালে-গাঁথা অসংখ্য ডাক-বাক্স আছে‌, কিন্তু হঠাৎ চোখে পড়ে না। ডাক-বাক্সের রাঙা গায়ে ইস্তাহারের কাগজ জুড়ে তাকে প্রায় অদৃশ্য করে তুলেছে। যারা জানে তাদের কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু যারা জানে না তাদের পক্ষে খুঁজে বার করা মুশকিল।

‘প্রথম যখন নেকলেস চুরির বয়ান শুনলাম‌, তখন তিনজনের ওপর সন্দেহ হল। ভোলা‌, মণিময় এবং মণিময়ের স্ত্রী‌, এদের মধ্যে একজন চোর। কিংবা এমনও হতে পারে যে‌, এই তিনজনের মধ্যে দু’জন ষড় করে চুরি করেছে। মণিময় এবং ভোলার মধ্যে ষড় থাকতে পারে‌, আবার স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ষড় থাকতে পারে। ভোলা এবং মণিময়ের স্ত্রীর মধ্যে সাজশ থাকার সম্ভাবনাটা বাদ দেওয়া যায়।

‘কিন্তু চুরি যে-ই করুক‌, চোরাই মাল গেল কোথায়? চুরি জানাজানি হবার একঘন্টার মধ্যে পুলিস এসে বাড়ির দোতলা তেতলা খানাতল্লাশ করেছিল‌, কিন্তু বাড়িতে মাল পাওয়া গেল না। একমাত্র ভোলাই দুপুর রাত্রে রাস্তায় নেমেছিল। কিন্তু সে বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল‌, দূরে যায়নি। অন্য কোনও লোকের সঙ্গে তার দেখাও হয়নি। ভোলা যদি চুরি করে থাকে‌, তবে সে নেকলেস নিয়ে করল। কী? মণিময় এবং তার স্ত্রীর সম্বন্ধে ওই একই প্রশ্ন-তারা গয়নাটা কোথায় লুকিয়ে রাখল?

‘তিনজনের ওপর সন্দেহ হলেও প্রধান সন্দেহভাজন ব্যক্তি অবশ্য ভোলা। মণিময় যখন নেকলেস এনে বাবাকে দিল তখন সে উপস্থিত ছিল। কেসের মধ্যে দামী গয়না আছে তা অনুমান করা তার পক্ষে শক্ত নয়। সন্ধ্যের সময় সে গামছা কেনার ছুতো করে বাইরে গিয়েছিল; এইটেই তার সবচেয়ে সন্দেহজনক কাজ। সে যদি বাইরের লোকের সঙ্গে সাজশ করে চুরির মতলব করে থাকে। তবে সহকারীকে খবর দিতে যাওয়া তার পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু সে গয়না। চুরি করে সহকারীকে দিল কী করে?

‘তারপর ধর মণিময়ের কথা। মনে কর‌, মণিময় আর তার স্ত্রীর মধ্যে সাজশ ছিল। মনে কর‌, রাত্রি এগারটার সময় মণিময় ক্লাব থেকে বাড়ি এসেছিল‌, বাপের দেরাজ থেকে গয়না চুরি করে আবার বেরিয়ে গিয়েছিল; তারপর গয়নাটা কোথাও লুকিয়ে রেখে পৌঁনে বারটার সময় বাড়ি ফিরে এসেছিল। অসম্ভব নয়; কিন্তু তা যদি হয়‌, তাহলে ভোলা কি জানতে পারত না? জানতে পারলে সে কি চুপ করে থাকত?

0 Shares