মাকড়সার রস

আমি কৌতূহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম–“কি লেখেন?”

“গল্প। কিম্বা আত্ম-চরিতও হতে পারে। একবার মাত্র সে-লেখার ওপর আমি চোখ বুলিয়েছিলুম, তারপর আর সেদিকে তাকাতে পারিনি। সে-লেখা পড়বার পর গঙ্গাস্নান করলেও মন পবিত্র হয় না। আজকালকার যাঁরা তরুন লেখক, সে-গল্প পড়লে তাঁদেরও বোধ করি দাঁত কপাটি লেগে যাবে।”

ব্যোমকেশ ঈষৎ হাসিয়া বলিল–“চরিত্রটি যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সমস্যাটি কি?”

মোহন আমাদের দু’জনকে দুটি সিগারেট দিয়া, একটি নিজে ধরাইয়া বলিল–“আপনারা ভাবছেন এমন গুণবান লোকের আর কোনো গুণ থাকা সম্ভব নয়–কেমন? কিন্তু তা নয়। এঁর আর একটি মস্ত গুণ আছে, এই শরীরের ওপর উনি এক অদ্ভুত নেশা করেন।”

সিগারেটে গোটা দুই টান দিয়া বলিল–“ব্যোমকেশবাবু, আপনি তো এই কাজের কাজের, সমাজের নিকৃষ্ট লোক নিয়েই আপনাকে কারবার করতে হয়, মদ গাঁজা চণ্ডু কোকেন ইত্যাদি অনেক রকম নেশাই মানুষকে করতে দেখে থাকবেন;–কিন্তু মাকড়সার রস খেয়ে কাউকে নেশা করতে দেখেছেন কি?”

আমি আঁৎকাইয়া উঠিয়া বলিলাম–“মাকড়সার রস! সে আবার কি?”

মোহন বলিল–“এক জাতীয় মাকড়সার রস আছে, যার শরীর থেকে এই বীভৎস বিষাক্ত রস পিষে বার করে নেওয়া হয়–”

ব্যোমকেশ কতকটা আত্মগতভাবে বলিল–“Tarantula Dance! স্পেনে আগে ছিল–এই মাকড়সার কামড় খেয়ে লোকে হরদম নাচত! দারুণ বিষ! বইয়ে পড়েছি বটে কিন্তু এদেশে কাউকে ব্যবহার করতে দেখিনি।”

মোহন বলিল–“ঠিক বলেছেন–ট্যারাণ্টুলা; সাউথ আমেরিকার স্পানিশ সঙ্কর জাতির মধ্যে এই নেশার খুব বেশি চলন আছে। এই ট্যারাণ্টুলার রস একটা তীব্র বিষ, কিন্তু খুব মাত্রায় ব্যবহার করলে শরীরের স্নায়ুমণ্ডলে একটা প্রবল উত্তেজনা সৃষ্টি করে। বুঝতেই পারছেন, স্বভাবের দোষে স্নায়ুবিক উত্তেজনা না হলে যারা থাকতে পারে না তাদের পক্ষে এই মাকড়সার রস কি রকম লোভনীয় বস্তু। কিন্তু নিয়মিত ব্যবহার করলে এর ফল সাংঘাতিক হয়ে দাঁড়ায়। অস্বাভাবিক পক্ষাঘাতে মৃত্যু অনিবার্য।

“আমাদের নন্দদুলালবাবু বোধহয় যৌবনকালে এই চমৎকার নেশাটি ধরেছিলেন; তারপর শরীর যখন অকর্মণ্য হয়ে পড়ল তখনো নেশা ছাড়তে পারলেন না। আমি যখন গৃহ-চিকিৎসক হয়ে ওঁদের বাড়িতে ঢুকলুম তখনো উনি প্রকাশ্যে ঐ নেশা চালাচ্ছেন, সে আজ বছরখানেকের কথা। আমি প্রথমেই ওটা বন্ধ করে দিলুম–বললুম, যদি বাঁচতে চান তাহলে ওটা ছাড়তে হবে।

“এই নিয়ে খুব খানিকটা ধস্তাধস্তি হল, তিনিও খাবেনই আমিও খেতে দেব না। শেষে আমি বললুম–“আপনার বাড়িতে ও জিনিস ঢুকতে দেব না, দেখি আপনি কি করে খান।” তিনিও কুটিল হেসে বললেন–“তাই নাকি? আচ্ছা, আমিও খাব, দেখি তুমি কি করে আটকাও।” যুদ্ধ ঘোষণা হয়ে গেল।

“পরিবারের আর সকলে আমার পক্ষে ছিলেন, সুতরাং সহজেই বাড়ির চারিদিকে কড়া পাহারা বসিয়ে দেওয়া গেল। তাঁর স্ত্রী ছেলেরা পালা করে তাঁকে পাহাড়া দিতে লাগলেন, যাতে কোনোক্রমে সে-বিষ তাঁর কাছে পৌঁছতে না পারে। তিনি নিজে একরকম চলৎশক্তিহীন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যে সে-জিনিস সংগ্রহ করবেন সে ক্ষমতা নেই। আমি এইভাবে তাঁকে আগ্‌লাবার ব্যবস্থা করে দিয়ে বেশ একটু আত্মপ্রসাদ অনুভব করতে লাগলুম।

“কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। এত কড়াকড়ি সত্ত্বেও বাড়িসুদ্ধ লোকের নজর এগিয়ে তিনি নেশা করতে লাগলেন; কোথা থেকে সে জিনিস আমদানি করেছেন কেউ ধরতে পারলুম না।

“প্রথমটা আমার সন্দেহ হল, হয়তো বাড়ির কেউ লুকিয়ে তাঁকে সাহায্য করছে। তাই একদিন আমি নিজে সমস্ত দিন পাহারায় রইলুম। কিন্তু আশ্চর্য মশায়, আমার চোখের সামনে তিন তিনবার সেই বিষ খেলেন। তাঁর নাড়ি দেখে বুঝলুম–অথচ কখন খেলেন ধরতে পারলুম না।

“তারপর তাঁর ঘর আঁতিপাঁতি করেছি, তাঁর সঙ্গে বাইরের লোকের দেখা করা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছি, কিন্তু তবু তাঁর মৌতাত বন্ধ করতে পারিনি। এখনো সমভাবে সেই ব্যাপার চলছে।

“এখন আমার সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই যে, লোকটা ঐ মাকড়সার রস পায় কোথা থেকে এবং পেলেও সকলের চোখে ধুলো দিয়ে খায় কি করে!”

মোহন চুপ করিল। ব্যোমকেশ শুনিতে শুনিতে অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছিল কিনা বলিতে পারি না, মোহন শেষ করিতেই সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল–“অজিত, বাড়ি চল। একটা কথা হঠাৎ মাথায় এসেছে, যদি তা ঠিক হয় তাহলে–”

বুঝিলাম সেই পুরানো জালিয়াৎ আবার তাহাকে চাপিয়া ধরিয়াছে। মোহন এতক্ষণ যে বকিয়া গেল তাহার শেষের দিকের কথাগুলো হয়তো তাহার কানেও যায় নাই। আমি একটু অপ্রতিভভাবে বলিলাম–“মোহনের গল্পটা বোধহয় তুমি ভাল করে শোনেনি–”

“বিলক্ষণ! শুনেছি বৈকি। সমস্যাটা খুব মজার–কৌতূহলও হচ্ছে–কিন্তু এখন কি আমার সময় হবে? আমি একটা বিশেষ শক্ত কাজে–”

মোহন মনে মনে বোধহয় একটু ক্ষুণ্ণ হইল, কিন্তু সে ভাব গোপন করিয়া বলিল–“তবে কাজ নেই–থাক। আপনাকে এইসব তুচ্ছ ব্যাপারে মাথা ঘামাতে অনুরোধ করা অবশ্য অনুচিত; কিন্তু–কি জানেন, এর একটা নিষ্পত্তি হলে হয়তো লোকটার প্রাণ বাঁচাতে পারা যেত। একটি লোক–যতবড় পাপিষ্ঠই হোক–বিন্দু বিন্দু বিষ খেতে আত্মহত্যা করছে চোখের সামনে দেখছি অথচ নিবারণ করতে পারছি না, এর চেয়ে দুঃখের বিষয় আর কি হতে পারে?”

ব্যোমকেশ একটু লজ্জিত হইয়া বলিল–“আমি করব না বলিনি তো। এ ধাঁধার উত্তর পেতে হলে ঘণ্টা দু’য়েক ভাবতে হবে; আর, একবার লোকটিকে দেখলেও ভাল হয়–কিন্তু আজ বোধহয় তা পেরে উঠব না। নন্দদুলালবাবুর মত অসামান্য লোককে কিছুতেই মরতে দেওয়া যেতে পারে না। সে আমি দেবোও না–আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। কিন্তু এখনি আমার বাসায় ফিরতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে জালিয়াৎ লোকটাকে ধরে ফেলেছি। কিন্তু একবার কাগজগুলো ভাল করে দেখা দরকার। –সুতরাং আজকের রাতটা নন্দদুলালবাবু নিশ্চিন্ত মনে বিষ পান করে নিন–কাল থেকে আমি তাঁকে জব্দ করে দেব।”

0 Shares