মাকড়সার রস

মোহন হাসিয়া বলিল–“বেশ, কালই হবে। কখন আপনার সুবিধা হবে বলুন–আমি ‘কার’ পাঠিয়ে দেব।”

ব্যোমকেশ একটু চিন্তা করিয়া বলিল–“আচ্ছা, এক কাজ করা যাক, তাতে আপনার উৎকণ্ঠাও অনেকটা লাঘব হবে। অজিত আজ আপনার সঙ্গে গিয়ে দেখেশুনে আসুক; তারপর ওর মুখে সব কথা শুনে আজ রাত্রেই কিম্বা কাল সকালে আমি আপনার ধাঁধার উত্তর দিয়ে দেব।”

ব্যোমকেশের বদলে আমি যাইব, ইহাতে মোহনের মুখে যে নিরাশার ভাব ফুটিয়া উঠল তাহা কাহারো চক্ষু এড়াইবার নয়। ব্যোমকেশ তাহা দেখিয়া হাসিয়া বলিল–“আপনার বাল্যবন্ধু বলেই বোধহয় অজিতের ওপর আপনার তেমন–ইয়ে–নেই। কিন্তু হতাশ হবেন না, সৎসঙ্গে পড়ে ওর বুদ্ধি এখন এমনি ভীষণ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে যে তার দু’ একটা দৃষ্টান্ত শুনলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। –হয়তো ও নিজেই আপনার এই ব্যাপারে সমস্ত রহস্য উদ্ঘাটিত করে দেবে, আমাকে দরকারও হবে না।”

এতবড় সুপারিশেও মোহন বিন্দুমাত্র উৎসাহিত হইল না। রুই কাৎলা ধরিবার আশায় ছিপ ফেলিয়া যাহারা সন্ধ্যাকালে পুঁটিমাছ ধরিয়া গৃহে প্রত্যাবর্তন করে তাহাদের মত মুখভার করিয়া সে বলিল–“অজিতই চলুক তাহলে। কিন্তু ও যদি না পারে–”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, সে আর বলতে! তখন তো আমি আছিই।” ব্যোমকেশ আমাকে আড়ালে ডাকিয়া বলিল–“সব জিনিস ভাল করে লক্ষ্য কোরো, আর চিঠিপত্র কি আসে খোঁজ নিও।”–এই বলিয়া সে প্রস্থান করিল।

ব্যোমকেশকে অনেক জটিল রহস্যের মর্মোদ্ঘাটন করিতে দেখিয়াছি ও তাহাতে সাহায্য করিয়াছি। তাহার অনুসন্ধান পদ্ধতিও এতদিন একসঙ্গে থাকিয়া অনেকটা আয়ত্ত হইয়াছে। তাই মনে মনে ভাবিলাম, এই সামান্য ব্যাপারের কিনারা করিতে পারিব না? বিশেষ, আমার প্রতি মোহনের বিশ্বাসের অভাব দেখিয়া ভিতরে ভিতরে একটা জিদও চাপিয়াছিল, যেমন করিয়া পারি এ ব্যাপারের নিষ্পত্তি করিব।

মনে মনে এইরূপ সঙ্কল্প আঁটিয়া মোহনের সহিত লেক হইতে বাহির হইলাম। বাস আরোহণে যখন নির্দিষ্ট স্থানের নিকট উপস্থিত হইলাম তখন সন্ধ্যা উর্ত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে–রাস্তার গ্যাস জ্বলিয়া উঠিতেছে। মোহন পথ দেখাইয়া লইয়া চলিল। সার্কুলার রোড হইতে একটা গলি ধরিয়া কিছুদূর অগ্রসর হইবার পর সম্মুখে একটা লোহার রেলিংযুক্ত বড় বাড়ি দেখাইয়া মোহন বলিল–“এই বাড়ি।”

দেখিলাম সেকেলে ধরনের পুরাতন বাড়ি, সম্মুখে লোহার ফটকে টুল পাতিয়া দারোয়ান বসিয়া আছে। মোহনকে দেখিয়া সেলাম করিয়া পথ ছাড়িয়া দিল, কিন্তু আমার প্রতি সন্দিগ্ধ দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল–“বাবুজি, আপকো ভিতর যানা–”

মোহন হাসিয়া বলিল–“ভয় নেই দারোয়ান, উনি আমার বন্ধু।”

“বহুত খুব”–দারোয়ান সরিয়া দাঁড়াইল; আমরা বাড়ির সম্মুখস্থ অঙ্গনে প্রবেশ করিলাম। অঙ্গন পার হইয়া বারান্দায় উঠিতেই ভিতর হইতে একটা বিশ-বাইশ বছরের যুবক বাহির হইয়া আসিল–“কে, ডাক্তারবাবু? আসুন।” আমার দিকে সপ্রশ্ন নেত্রে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল–“ইনি–?”

মোহন তাহাকে একটু তফাতে লইয়া গিয়া নিম্নকণ্ঠে কি বলিল, যুবকও উত্তর দিল–“বেশ তো, বেশ তো, উনি আসুন না–”

মোহন তখন পরিচয় করাইয়া দিল–গৃহস্বামীর জ্যোষ্ঠপুত্র, নাম অরুণ। তাহার অনুবর্তী হইয়া আমরা বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিলাম। দুইটা ঘর অতিক্রম করিয়া তৃতীয় ঘরের বন্ধ দরজায় করাঘাত করিতেই ভিতর হইতে একটা কহল-তীক্ষ্ণ ভাঙা কণ্ঠস্বর শুনা গেল–“কে? কে তুমি? এখন আমায় বিরক্ত করো না, আমি লিখছি।”

অরুণ বলিল–“বাবা, ডাক্তারবাবু এসেছেন। অভয়, দোর খোল।” একটি আঠারো-উনিশ বছর বয়সের যুবক–বোধহয় গৃহস্বামীর দ্বিতীয় পুত্র–দ্বার খুলিয়া দিল। আমরা সকলে ঘরে প্রবেশ করিলাম।

অরুণ চুপিচুপি অভয়কে জিজ্ঞাসা করিল–“খেয়েছেন?”

অভয় ম্লানভাবে ঘাড় নাড়িল।

ঘরে ঢুকিয়াই প্রথমে দৃষ্টি পড়িল, ঘরের মধ্যস্থলে ঘাটের উপর বিছানা পাতা রহিয়াছে এবং সেই বিছানায় বালিশে ঠেস দিয়া বসিয়া, ডান হাতে উত্থিত কলম ধরিয়া, অতি শীর্ণকায় নন্দদুলালবাবু ক্রুদ্ধ কষায়িত নেত্রে আমাদের দিকে চাহিয়া আছেন। মাথার উপর উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলো জ্বলিতেছিল, আর একটা টেবিল-ল্যাম্প ঘাটের ধারে উঁচু টিপাইয়ের উপর রাখা ছিল; তাই লোকটির সমস্ত অবয়ব ভাল করিয়া দেখিতে পাইলাম। তাঁহার বয়স বোধ করি পঞ্চাশের নীচেই কিন্তু মাথার চুল সমস্ত পাকিয়া একটা শ্রীহীন পাঁশুটে বর্ণ ধারণ করিয়াছে। হাড় চওড়া, ধারালো মুখে মাংসের লেশমাত্র নাই, হনুর অস্থি দু’টা যেন চর্ম ভেদ করিয়া বাহির হইয়াবার উপক্রম করিতেছে–পাৎলা দ্বিধা-ভগ্ন নাকটা মুখের উপর গৃধ্রের মত ঝুলিয়া পড়িয়াছে। চোখ দু’টা কোনো অস্বাভাবিক উত্তেজনার ফলে অত্যন্তু উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু উত্তেজনার অবসানে আবার যে তাহারা মৎস্যচক্ষুর মত ভাবলেশহীন হইয়া পড়িবে তাহার আভাসও সে-চক্ষে লুক্কায়িত আছে। নিম্নের ঠোঁট শিথিল হইয়া ঝুলিয়া পড়িয়াছে। সব মিলিয়া মুখের উপর একটা কদাকার ক্ষুধিত অসন্তোষ যেন রেখায় রেখায় চিহ্নিত হইয়া আছে।

কিছুক্ষণ এই প্রেতাকৃতি লোকটির দিকে বিস্মিতভাবে চাহিয়া থাকিয়া দেখিলাম, তাঁহার বাঁ হাতটা থাকিয়া থাকিয়া অকারণে আনর্তিত হইয়া উঠিতেছে, যেন সেটা স্বাধীনভাবে, দেহ হইতে সম্পূর্ণ বিযুক্ত হইয়া নৃত্য শুরু করিয়া দিয়াছে। মৃত ব্যাঙের দেহ তড়িৎ সংস্পর্শে চমকাইয়া উঠিতে যাঁহারা দেখিয়াছে, তাঁহারা এই স্নায়ু-নৃত্য কতকটা আন্দাজ করিতে পারিবেন।

0 Shares