মাকড়সার রস

নন্দদুলালবাবুও বিষদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাইয়া ছিলেন, সেই ভাঙা অথচ তীব্র স্বরে বলিয়া উঠিলেন–‘ডাক্তার! এ আবার কাকে নিয়ে এসেছ এখানে? কি চায় লোকটা? যেতে বল–যেতে বল–”

মোহন চোখের একটা ইশারা করিয়া আমাকে জানাইলা যে আমি যেন গৃহস্বামীর এরূপ সম্ভাষণে কিছু মনে না করি; তারপর শয্যার উপর হইতে বিক্ষিপ্ত কাগজগুলো সরাইয়া শয্যাপার্শ্বে রাখিয়া রোগীর নাড়ি হাতে লইয়া স্থির হইয়া দেখিতে লাগিল। নন্দদুলালবাবু মুখে একটা বিকৃত হাস্য লইয়া একবার আমার পানে একবার ডাক্তারের পানে তাকাইতে লাগিলেন। বাঁ হাতটা তেমনি নৃত্য করিতে লাগিল।

শেষে হাত ছাড়িয়া দিয়া মোহন বলিল–“আবার খেয়েছেন?”

“বেশ করেছি খেয়েছে–কার বাবার কি?”

মোহন অধর দংশন করিল, তারপর বলিল–“এতে নিজেরই কেবল ক্ষতি করছেন। আর কারু নয়। কিন্তু সে তো আপনি বুঝবেন না, বোঝবার ক্ষমতাই নেই। ঐ বিষ খেয়ে খেয়ে মস্তিষ্কের দফা রফা করে ফেলেছেন।”

নন্দদুলালবাবু মুখের একটা পৈশাচিক বিকৃতি করিয়া বলিলেন–“তাই নাকি এয়ার? মস্তিষ্কের দফা রফা করে ফেলেছি? কিন্তু তোমার ঘটে তো অনেক বুদ্ধি আছে? তবে ধরতে পারছ না কেন? বলি, চারিদিকে তো সেপাই বসিয়ে দিয়েছ–কই, ধরতে পারলে না?” বলিয়া হি হি করিয়া এক অশ্রাব্য হাসি হাসিতে লাগিলেন।

মোহন বিরক্তভাবে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল–“আপনার সঙ্গে কথা কওয়াই ঝকমারি। যা করছিলেন করুন।”

নন্দদুলালবাবু পূর্ববৎ হি-হি করিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন–“দুয়ো ডাক্তার, দুয়ো। আমায় ধরতে পারলে না, ধিনতা ধিনা পাকা নোনা–” সঙ্গে সঙ্গে দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গষ্ঠ তুলিয়া নাড়িতে লাগিলেন।

নিজের পুত্রদের সম্মুখে এই কদর্য অসভ্যতা আমার অসহ্য বোধ হইতে লাগিল; মোহনেরও বোধ করি ধৈর্যের বন্ধন ছিঁড়িবার উপক্রম করিতেছিল, সে আমাকে বলিল–“নাও অজিত, কি দেখবে দেখেশুনে নাও–আর পারা যায় না।”

হঠাৎ বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ আস্ফালন থামাইয়া নন্দদুলালবাবু দুই সর্প-চক্ষু আমার দিকে ফিরাইয়া কটুকণ্ঠে কহিলেন–“কে হে তুমি–আমার বাড়িতে কোন্‌ মতলবে ঢুকেছ?” আমি কোন জবাব দিলাম না, তখন–“চালাকি করবার আর জায়গা পাওনি? ওসব ফন্দি ফিকির এখানে চলবে না যাদু–বুঝেছ? এইবেলা চটপট সড়ে পড়, নইল পুলিস ডাকব। যত নচ্ছার ছিঁচকে চোরের দল।” বলিয়া মোহনকেও নিজের দৃষ্টির মধ্যে সাপটাইয়া লইলেন। সে আমাকে কি উদ্দেশ্যে আনিয়াছে ঠিক না বুঝিলেও আমার উপর তাঁহার ঘোর সন্দেহ জন্মিয়াছিল।

অরুণ লজ্জিতভাবে আমার কানে কানে বলিল–“ওঁর কথায় কান দেবেন না। ওটা খেলে ওঁর আর জ্ঞান বুদ্ধি থাকে না।”

মনে মনে ভাবিলাম, কি ভয়ঙ্কর এই বিষ যাহা মানুষের সমস্ত গোপন দুষ্প্রবৃত্তিকে এমন উগ্র প্রকট করিয়া তোলে! যে ব্যক্তি জানিয়া শুনিয়া ইহা খায় তাহার নৈতিক অধোগতির মাত্রাই বা কে নিরূপণ করিবে?

ব্যোমকেশ বলিয়াছিল সব দিক ভাল করিয়া লক্ষ্য করিতে, তাই যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি ঘরের চতুর্দিক ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিয়া লইলাম। ঘরটা বেশ বড়, আসবাবপত্রও অধিক নাই–একটা খাট, গোটা দুই দিন চেয়ার, একটা আলমারি ও একটা তেপায়া টেবিল। এই টেবিলের উপর ল্যাম্পটা রাখা আছে এবং তাহারি পাশে কয়েক দিস্তা অলিখিত কাগজ ও অন্যান্য লেখার সরঞ্জাম রহিয়াছে। লিখিত কাগজপত্রগুলো অবিন্যস্তভাবে চারিদিকে ছড়ানো। আমি একটা কাগজ তুলিয়া লইয়া কয়েক ছত্র পড়িয়াই শিহরিয়া রাখিয়া দিলাম;–মোহন যাহা বলিয়াছিল তাহা সত্য। এ লেখা পড়িলে ফরাসী বস্তুতান্ত্রিক এমিল জোলারও বোধ করি গা ঘিন্‌ ঘিন্‌ করিত। শুধু তাই নয়, লেখার বিশেষ রসালো স্থলগুলিতে লাল কালির দাগ দিয়ে লেখক মহাশয় সেইদিকে দৃষ্টি আকর্ষণের ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন। বস্তুত, এতখানি নোংরা জঘন্য মনের পরিচয় আর কোথাও পাইয়াছি বলিয়া স্মরণ হইল না।

নন্দদুলালবাবুর দিকে একটা ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া দেখিলাম, তিনি আবার লেখায় মন দিয়াছেন। পার্কারের কলম দ্রুতবেগে কাগজের উপর সঞ্চরণ করিয়া চলিয়াছে, পাশের টেবিলে দোয়াতদানিতে আর একটা মেটে লাল রঙের পার্কারের ফাউণ্টেন পেন রাখা আছে, লেখা শেষ হইলেই বোধ করি দাগ দেওয়া আরম্ভ হইবে।

হইলও তাই। পাতাটা শেষ হইতেই নন্দদুলালবাবু কালো কলম রাখিয়া লাল কলমটা তুলিয়া লইলেন। আঁচড় কাটিয়া দেখিলেন, কালি ফুরাইয়া গিয়াছে–তখন টেবিলের উপর হইতে লাল কালির চ্যাপ্টা শিশি লইয়া তাহাতে কালি ভরিলেন, তারপর গম্ভীরভাবে নিজের লেখার মণিমুক্তাগুলি চিহ্নিত করিতে লাগিলেন।

আমি মুখ ফিরাইয়া লইয়া ঘরের অন্যান্য জিনিস দেখিতে লাগিলাম। আলমারিটাতে কিছু ছিল না, শুধু কতকগুলো অর্ধেক ঔষধের শিশি পড়িয়াছিল। মোহন বলিল, সেগুলো তাহারই প্রদত্ত ঔষধ। ঘরে দু’টি জানালা, দু’টি দরজা। একটি দরজা দিয়া আমরা প্রবেশ করিয়াছিলাম, অন্যটি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, ওদিকে স্নানের ঘর ইত্যাদি আছে। সে ঘরটাও দেখিলাম; বিশেষ কিছু নাই, কয়েকতা কাচা কাপড় তোয়ালে তেল সাবান মাজন ইত্যাদি রহিয়াছে।

জানাল দু’টা সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিয়া জানা গেল, বাহিরের সহিত উহাদের কোনো যোগ নাই, তাছাড়া অধিকাংশ সময়ই বন্ধ থাকে। ব্যোমকেশ থাকিলে কি ভাবে অনুসন্ধান করিত তাহা কল্পনা করিবার চেষ্টা করিলাম কিন্তু কিছুই ভাবিয়া পাইলাম না। দেয়ালে টোকা মারিয়া দেখিব কি না ভাবিতেছি–হয়তো কোথাও গুপ্ত দরজা আছে–এমন সময় চোখে পড়িল দেয়ালে একটা তাকের উপর একটা চাঁদির আরতদানি রহিয়াছে। সাগ্রহে সেটাকে পরীক্ষা করিলাম; তাহার মধ্যে খানিকটা তুলা ও খোপে খোপে আতর রহিয়াছে। চুপি চুপি অরুণকে জিজ্ঞাসা করিলাম–“উনি আরত মাখেন নাকি?”

0 Shares