মাকড়সার রস

সে অনিশ্চতভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল–“কি জানি। বোধহয় না; মাখলে তো গন্ধ পাওয়া যেত।”

“এটা কতদিন এঘরে আছে?”

তা বরাবরই আছে। বাবাই ওটা আনিতে ঘরে রেখেছিলেন।”

ঘাড় ফিরাইয়া দেখিলাম, লেখা বন্ধ করিয়া নন্দদুলালবাবু এই দিকেই তাকাইয়া আছেন। মন উত্তেজিত হইয়া উঠিল; খানিকটা তুলা আতরে ভিজাইয়া পকেটে পরিয়া লইলাম।

তারপর ঘরের চারিদিকে একবার শেষ দৃষ্টিপাত করিয়া বাহির হইয়া আসিলাম। নন্দদুলালবাবুর দৃষ্টি আমাকে অনুসরণ করিল; দেখিলাম তাঁহার মুখে সেই শ্লেষপূর্ণ কদর্য হাসিটা লাগিয়া আছে।

বাহিরে আসিয়া আমরা বারান্দায় বসিলাম। আমি বলিলাম–“এখন আপনাদের কয়েকটা প্রশ্ন করিতে চাই, কোনো কথা গোপন না করে উত্তর দেবেন।”

অরুণ বলিল–“বেশ, জিজ্ঞাসা করুন।”

আমি বলিলাম–“আপনারা ওঁকে সর্বদা নজরবন্দীতে রেখেছেন? কে কে পাহারা দেয়?”

“আমি, অভয় আর মা পালা করে ওঁর কাছে থাকি। চাকর-বাকর বা অন্য কাউকে কাছে যেতে দিই না।”

“ওঁকে কখনও ও জিনিস খেতে দেখেছেন?”

“না–মুখে দিতে দেখিনি। তবে খেয়েছেন তা জানতে পেরেছি।”

“জিনিসটার চেহারা কি রকম কেউ দেখেছেন?”

“যখন প্রকাশ্যে খেতেন তখন দেখেছিলুম–জলের মত জিনিস, হোমিওপ্যাথিক শিশিতে থাকত; তাই কয়েক ফোঁটা সরবৎ কিম্বা অন্য কিছুর সঙ্গে মিশিয়ে খেতেন।”

“সে রকম শিশি ঘরে কোথাও নেই–ঠিক জানেন?”

“ঠিক জানি। আমরা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি।”

“তাহলে নিশ্চয় বাইরে থেকে আসে। কে আনে?”

অরুণ মাথা নাড়িল–“জানি না।”

“আপনারা তিনজন ছাড়া আর কেউ ও-ঘরে ঢোকে না? ভাল করে ভেবে দেখুন।”

“না–কেউ না। এক ডাক্তারবাবু ছাড়া।”

আমার জেরা ফুরাইয়া গেল–আর কি জিজ্ঞাসা করিব? গালে হাত দিয়া ভাবিতে ভাবিতে ব্যোমকেশের উপদেশ স্মরণ হইল; পুনশ্চ আরম্ভ করিলাম–“ওঁর কাছে কোনো চিঠিপত্র আসে?”

“না।”

“কোনো পার্সেল কি অন্য রকম কিছু?”

এইবার অরুণ বলিল–“হ্যাঁ–হপ্তায় একখানা করে রেজিস্ট্রি চিঠি আসে।”

আমি উৎসাহে লাফাইয়া উঠিলাম–“কোথেকে আসে? কে পাঠায়?”

লজ্জায় ঘাড় নীচু করিয়া অরুণ আস্তে আস্তে বলিল–“কলকাতা থেকেই আসে–রেবেকা লাইট নামে একজন স্ত্রীলোক পাঠায়।”

আমি বলিলাম–“হুঁ–বুঝেছি। চিঠিতে কি থাকে আপনারা দেখেছেন কি?”

“দেখেছি।” বলিয়া অরুণ মোহনের পানে তাকাইল।

আমি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলাম–“কি থাকে?”

“সাদা কাগজ।”

“সাদা কাগজ?”

“হ্যাঁ–খালি কতকগুলো সাদা কাগজ খামের মধ্যে পোরা থাকে–আর কিছু না।”

আমি হতবুদ্ধির মত প্রতিধ্বনি করিলাম–“আর কিছু না?”

“না।”

কিছুক্ষণ নির্বাক হইয়া তাকাইয়া রহিলাম; শেষে বলিলাম–“ঠিক জানেন খামের ভিতর আর কিছু থাকে না?”

অরুণ একটু হাসিয় বলিল–“ঠিক জানি। বাবা নিজে পিওনের সামনে রসিদ দস্তখত করে চিঠি নেন বটে কিন্তু আগে আমিই চিঠি খুলি। তাতে সাদা কাগজ ছাড়া আর কিছুই থাকে না।”

“প্রত্যেক বার আপনিই চিঠি খোলেন? কোথায় খোলেন?”

“বাবার ঘরে। সেইখানেই পিওন চিঠি নিয়ে যায় কিনা।”

“কিন্তু এ তো ভারি আশ্চর্য ব্যাপার! সাদা কাগজ রেজিস্ট্রি করে পাঠাবার মানে কি?”

মাথা নাড়িয়া অরুণ বলিল–“জানি না।”

আরো কিছুক্ষণ বোকার মত বসিয়া থাকিয়া শেষে একটা নিশ্বাস ফেলিয়া উঠিয়া পড়িলাম। রেজিস্ট্রি চিঠির কথা শুনিয়া মনে আশা হইয়াছিল, যে ফন্দিটা বুঝি ধরিয়া ফেলিয়াছি–কিন্তু না, ওদিকের দরজায় একেবারে তালা লাগানো। বুঝিলাম, আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপার সামান্য ঠেকিলেও আমার বুদ্ধিতে কুলাইবে না। ‘তুলা শুনিতে নরম কিন্তু ধুনিতে লবেজান।’ ঐ বিষজর্জরিতদেহ অকালপঙ্গু বুড়া লম্পটকে আঁটিয়া ওঠা আমার কর্ম নয়–এখানে ব্যোমকেশের সেই শানিত ঝক্‌ঝকে মস্তিষ্কটি দরকার।

মলিন মুখে, ব্যোমকেশকে সকল কথা জানাইব বলিয়া বাহির হইতেছে, একটা কথা স্মরণ হইল। জিজ্ঞাসা করিলাম–“নন্দদুলালবাবু কাউকে চিঠিপত্র লেখেন?”

অরুণ বলিল–“না, তবে মাসে মাসে মানিঅর্ডার করে টাকা পাঠান।”

“কাকে পাঠান?”

লজ্জাম্লান মুখে অরুণ বলিল–“ঐ ইহুদি স্ত্রীলোকটাকে।”

মোহন ব্যাখ্যা করিয়া বলিল–“ঐ স্ত্রীলোকটা আগে নন্দদুলালবাবুর–”

“বুঝেছি। কত টাকা পাঠান?”

“এক শ টাকা। কিন্তু কেন পাঠান তা বলতে পারি না।”

মনে মনে ভাবিলাম–পেনশন। কিন্তু মুখে সে-কথা না বলিয়া একাকী বাহির হইয়া পড়িলাম। মোহন রহিয়া গেল।

বাসায় পৌঁছতে রাত্রি আটটা বাজিল।

ব্যোমকেশ লাইব্রেরি ঘরে ছিল, দ্বারে ধাক্কা দিতেই কবাট খুলিয়া বলিল–“কি খবর? সমস্যা-ভঞ্জন হল?”

“না”–আমি ঘরে ঢুকিয়া একটা চেয়ারে বসিয়া পড়িলাম। ইতিপূর্বে ব্যোমকেশ একটা মোটা লেন্স লইয়া একখণ্ড কাগজ পরীক্ষা করিতেছিল, এখন আবার যন্ত্রটা তুলিয়া লইল। তারপর আমার দিকে একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হানিয়া বলিল–“ব্যাপার কি? এত শৌখিন হয়ে উঠলে কবে থেকে? আতর মেখেছ যে?”

“মাখিনি। নিয়ে এসেছি।” তাহাকে আদ্যোপান্ত সমস্ত বিবরণ বর্ণনা করিয়া শুনাইলাম, সে-ও বোধ হইল মন দিয়া শুনিল। উপসঙ্ঘারে আমি বলিলাম–“আমার দ্বারা তো হল না ভাই–এখন দেখ, তুমি যদি কিছু পার। তবে আমার মনে হয়, এই আতরটা অ্যানালাইজ্‌ করলে কিছু পাওয়া যেতে পারে–”

“কি পাওয়া যাবে–মাকড়সার রস?” ব্যোমকেশ আমার হাত হইতে তুলাটা লইয়া তাহার আঘ্রাণ গ্রহণ করিয়া বলিল–“আঃ! চমৎকার গন্ধ! খাঁটি অম্বুরি আতর।” তুলাটা হাতের চামড়ার উপর ঘষিতে ঘষিতে বলিল–“হ্যাঁ–কি বলছিলে? কি পাওয়া যেতে পারে?”

0 Shares