মাকড়সার রস

বসিবার ঘরে ফিরিয়া আসিয়া লজ্জিত মুখে বলিলাম–“কতক-কতক যেন বুঝতে পারছি’ কিন্তু তুমি সব কথা পরিষ্কার করে বল। কেমন করে বুঝলে?”

ঘড়ির দিকে একবার দৃষ্টিপাত করিয়া ব্যোমকেশ বলিল–“খাবার সময় হল, এখনি পুঁটিরাম ডাকতে আসবে। আচ্ছা, চটপট বলে নিচ্ছি শোনো।–প্রথম থেকেই তুমি ভুল পথে যাচ্ছিলে। দেখতে হবে জিনিসটা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে কি করে। তার নিজের হাত পা নেই, সুতরাং কেউ তাকে নিশ্চয়ই দিয়ে আসে। কে সে? ঘরের মধ্যে পাঁচজন লোক ঢুকতে পায়–ডাক্তার, দুই ছেলে, স্ত্রী এবং আর একজন। প্রথম চারজন বিষ খাওয়াবে না এটা নিশ্চিত, অতএব এ পঞ্চম ব্যক্তির কাজ।”

“পঞ্চম ব্যক্তি কে?”

“পঞ্চম ব্যক্তি হচ্ছে–পিওন। সে হপ্তায় একবার সই করবার জন্যে নন্দদুলালবাবুর ঘরে ঢোকে। সুতরাং তার মারফতেই জিনিসটা ঘরে প্রবেশ করে।”

“কিন্তু খামের মধ্যে তো সাদা কাগজ ছাড়া আর কিছু থাকে না।”

“ঐখানেই ফাঁকি। সবাই মনে করে খামের মধ্যে জিনিসটা আছে, তাই পিওনকে কেউ লক্ষ্য করে না। লোকটা হুঁশিয়ার, সে অনায়াসে লাল কালির দোয়াত বদলে দিয়ে চলে যায়। রেজিস্ট্রি করে সাদা কাগজ পাঠাবার উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোনো ক্রমে পিওনকে নন্দদুলালবাবুর ঘরে ঢোকবার অবকাশ দেওয়া।”

“তারপর?”

“তুমি আর একটা ভুল করেছিলে; ইহুদি স্ত্রীলোকটাকে টাকা পাঠানো হয়–পেনশন স্বরূপ নয়, ও প্রথা কোথাও প্রচলিত নেই–টাকা ওষুধের দাম, ওই মাগীই পিওনের হাতে ওষুধ সরবরাহ করে।

“তাহলে দেখ, ওষুধ নন্দদুলালবাবুর হাতের কাছে এসে পৌঁছল, কেউ জানতে পারলে না। কিন্তু অষ্টপ্রহর ঘরে লোক থাকে, তিনি খাবেন কি করে? নন্দদুলালবাবু গল্প লিখতে আরম্ভ করলেন। সর্বদাই হাতের কাছে লেখার সরঞ্জাম রয়েছে, তাই উঠে গিয়ে খাবারও দরকার নেই–খাটের ওপর বসেই সে কার্য সম্পন্ন করা যায়। তিনি কালো কলম দিয়ে গল্প লিখছেন, লাল কলম দিয়ে তাতে দাগ দিচ্ছেন, ফাঁক পেলেই কলমের নিবটি চুষে নিচ্ছেন। কালি ফুরিয়ে গেলে আবার ফাউণ্টেন পেন ভরে নিচ্ছেন। জিভের রঙ লাল কেন এখন বুঝতে পারছে?”

“কিন্তু লালই যে হবে তা বুঝলে কি করে? কালোও তো হতে পারত?”

“হায় হায়, এটা বুঝলে না! কালো কালি যে বেশি খরচ হয়। নন্দদুলালবাবু ঐ অমূল্যনিধি কি বেশি খরচ হতে দিতে পারেন? তাই লাল কালির ব্যবস্থা।”

“বুঝেছি।–এত সহজ–”

“সহজ তো বটেই। কিন্তু যে-লোকের মাথা থেকে এই সহজ বুদ্ধি বেরিয়েছে তার মাথাটা অবহেলার বস্তু নয়। এত সহজ বলেই তোমরা ধরতে পারছিলে না।”

“তুমি ধরলে কি করে?”

“খুব সহজে। এই ব্যাপারে দুটো জিনিস সম্পূর্ণ নিরর্থক বলে মনে হয়–এক, রেজিস্ট্রি করে সাদা কাগজ আসা; দুই, নন্দদুলালবাবুর গল্প লেখা। এই দুটোর সত্যিকার কারণ খুঁজতে গিয়েই আসল কথাটি বেরিয়ে পড়ল।”

পাশের ঘরে ঝন্‌ ঝন্‌ করিয়া টেলিফোনের ঘণ্টি বাজিয়া উঠিল, আমরা দু’জনেই তাড়াতাড়ি উঠিয়া গেলাম। ব্যোমকেশ ফোন ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল–“কে আপনি? ও–ডাক্তারবাবু, কি খবর?…নন্দদুলালবাবু চেঁচামেচি করছেন?…হাত পা ছুড়ছেন? তা হোক, তা হোক, তাতে কোনো ক্ষতি হবে না।…অ্যাঁ! কি বলছেন? অজিতকে গালাগাল দিচ্ছেন? শকার বকার তুলে?…ভারি অন্যায়। ভারি অন্যায় কিন্তু–যখন তাঁর মুখ বন্ধ করা যাচ্ছে না তখন আর উপায় কি?…অজিত অবশ্য ওসব গ্রাহ্য করে না; অবিমিশ্র প্রশংসা যে পৃথিবীতে পাওয়া যায় না তা সে জানে। মধু ও হুল–কমলে কণ্টক…এই জগতের নিয়ম…আচ্ছা নমস্কার।”

(সমাপ্ত)

0 Shares