রক্তমুখী নীলা

টেবিলের উপর পা তুলিয়া ব্যোমকেশ পা নাচাইতেছিল। খোলা সংবাদপত্রটা তাহার কোলের উপর বিস্তৃত। শ্রাবণের কর্মহীন প্ৰভাতে দু’জনে বাসায় বসিয়া আছি; গত চারদিন ঠিক এইভাবে কাটিয়াছে। আজকারও এই ধারাভ্রাবি ধূসর দিনটা এইভাবে কাটিবে‌, ভাবিতে ভাবিতে বিমর্ষ হইয়া পড়িতেছিলাম।

ব্যোমকেশ কাগজে মগ্ন; তাহার পা স্বেচ্ছামত নাচিয়া চলিয়াছে। আমি নীরবে সিগারেট টানিয়া চলিয়াছি; কাহারও মুখে কথা নাই। কথা বলার অভ্যাস যেন ক্ৰমে ছুটিয়া যাইতেছে।

কিন্তু চুপ করিয়া দু’জনে কাঁহাতক বসিয়া থাকা যায়? অবশেষে যা হোক একটা কিছু বলিবার উদ্দেশ্যেই বলিলাম‌, ‘খবর কিছু আছে?’

ব্যোমকেশ চোখ না তুলিয়া বলিল‌, ‘খবর গুরুতর-দু’জন দাগী আসামী সম্প্রতি মুক্তিলাভ করেছে।’

একটু আশান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘কে তাঁরা? ‘একজন হচ্ছেন। শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীন—তিনি মুক্তিলাভ করেছেন বিচিত্রা নামক টকি হাউসে; আর একজনের নাম শ্ৰীযুত রমানাথ নিয়োগী-ইনি মুক্তিলাভ করেছেন আলিপুর জেল থেকে। দশ দিনের পুরনো খবর‌, তাই আজ ‘কালকেতু’ দয়া করে জানিয়েছেন।’ বলিয়া সে ক্রুদ্ধ-হতাশ ভঙ্গীতে কাগজখানা ফেলিয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

বুঝিলাম সংবাদের অপ্রচুর্যে বেচারা ভিতরে ভিতরে ধৈর্য হারাইয়াছে। অবশ্য আমাদের পক্ষে নৈষ্কর্মের অবস্থাই স্বাভাবিক; কিন্তু তাই বলিয়া এই বর্ষার দিনে তাজা মুড়ি-চালভাজার মত সংবাদপত্রে দু’ একটা গরম গরম খবর থাকিবে না-ইহাই বা কেমন কথা। বেকারের দল তবে বাঁচিয়া থাকিবে কিসের আশায়?

তবু্‌, ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল।’ বলিলাম‌, ‘শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীনকে তো চিনি‌, কিন্তু রমানাথ নিয়োগী মহাশয়ের সঙ্গে পরিচয় নেই। তিনি কে?’

ব্যোমকেশ ঘরময় পায়চারি করিল‌, জানোলা দিয়া বাহিরে বৃষ্টি-ঝান্সা আকাশের পানে তাকাইয়া রহিল‌, তারপর বলিল‌, ‘নিয়োগী মহাশয় নিতান্ত অপরিচিত নয়। কয়েক বছর আগে তাঁর নাম খবরের কাগজে খুব বড় বড় অক্ষরেই ছাপা হয়েছিল। কিন্তু সাধারণ পাঠকের স্মৃতি এত হ্রস্ব যে দশ বছর আগের কথা মনে থাকে না।’

‘তা ঠিক। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর তো পেলুম না। কে তিনি?’

‘তিনি একজন চোর। ছিচকে চোর নয়‌, ঘটিবাটি চুরি করেন না। তাঁর নজর কিছু উঁচু—‘মারি তো গণ্ডার লুটি তো ভাণ্ডার।’ বুদ্ধিও যেমন অসাধারণ সাহসও তেমনি অসীম।’–ব্যোমকেশ স-খেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলিল‌, ‘আজকাল আর এরকম লোক পাওয়া যায় না।

বলিলাম‌, ‘দেশের দুভাগ্য সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর নাম বড় বড় অক্ষরে খবরের কাগজে উঠেছিল। কেন?’

‘কারণ শেষ পর্যন্ত তিনি ধরা পড়ে গিয়েছিলেন এবং প্রকাশ্য আদালতে তাঁর বিচার হয়েছিল।’ টেবিলের উপর সিগারেটের টিন রাখা ছিল‌, একটা সিগারেট তুলিয়া লইয়া ব্যোমকেশ যত্ন সহকারে ধরাইল; তারপর আবার চেয়ারে বসিয়া পড়িয়া বলিল‌, ‘দশ বছর হয়ে গেল। কিন্তু এখনও ঘটনাগুলো বেশ মনে আছে। তখন আমি সবেমাত্র এ কাজ আরম্ভ করেছি।–তোমার সঙ্গে দেখা হবারও আগে–’

দেখিলাম‌, ঔদাস্যভরে বলিতে আরম্ভ করিয়া সে নিজেই নিজের স্মৃতিকথায় আকৃষ্ট হইয়া পড়িয়াছে। বষ্যর দিনে যখন অন্য কোনও মুখরোচক খাদ্য হাতের কাছে নাই‌, তখন স্মৃতিকথাই চলুক-এই ভাবিয়া আমি বলিলাম‌, ‘গল্পটা বল শুনি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘গল্প কিছু নেই। তবে ব্যাপারটা আমার কাছে একটা কারণে রহস্যময় হয়ে আছে। পুলিস খেটেছিল খুব এবং বাহাদুরিও দেখিয়েছিল অনেক। কিন্তু আসল জিনিসটি উদ্ধার করতে পারেনি।’

‘আসল জিনিসটি কি?’

‘তবে বলি শোন। সে সময় কলকাতা শহরে হঠাৎ জহরত চুরির খুব ধুম পড়ে গিয়েছিল; আজ জহরলাল হীরালালের দোকানে চুরি হচ্ছে‌, কাল দত্ত কোম্পানির দোকানে চুরি হচ্ছে-এই রকম ব্যাপার। দিন পনেরোর মধ্যে পাঁচখানা বড় বড় দোকান থেকে প্ৰায় তিন চার লক্ষ টাকার হীরা জহরত লোপাট হয়ে গেল। পুলিস সজোরে তদন্ত লাগিয়ে দিলে।

‘তারপর একদিন মহারাজ রমেন্দ্ৰ সিংহের বাড়িতে চুরি হল। মহারাজ রমেন্দ্ৰ সিংহের পরিচয় দিয়ে তোমায় অপমান করব না‌, বাঙালীর মধ্যে তাঁর নাম জানে না। এমন লোক কমই আছে। যেমন ধনী তেমনি ধাৰ্মিক। তাঁর মত সহৃদয় দয়ালু লোক আজকালকার দিনে বড় একটা দেখা যায় না। সম্প্রতি তিনি একটু বিপদে জড়িয়ে পড়েছেন—কিন্তু সে থাক। ভাল ভাল জহরত। সংগ্ৰহ করা তাঁর একটা শখ ছিল; বাড়িতে দোতলার একটা ঘরে তাঁর সংগৃহীত জহরতগুলি কাচের শো-কেসে সাজান থাকত। সতর্কতার অভাব ছিল না; সেপাই সাস্ত্রী চৌকিদার অষ্টপ্রহর পাহারা দিত। কিন্তু তবু একদিন রাত্ৰিবেলা চোর ঢুকে দু’জন চৌকিদারকে অজ্ঞান করে তাঁর কয়েকটা দামী জহরত নিয়ে পালাল।

‘মহারাজের সংগ্রহে একটা রক্তমুখী নীলা ছিল‌, সেটা তাঁর অত্যন্ত প্ৰিয়। নীলাটাকে মহারাজ নিজের ভাগ্যলক্ষ্মী মনে করতেন; সর্বদা আঙুলে পরে থাকতেন। কিন্তু কিছুদিন আগে সেটা আংটিতে আলগা হয়ে গিয়েছিল বলে খুলে রেখেছিলেন। বোধহয় ইচ্ছে ছিল‌, স্যাকরা ডাকিয়ে মেরামত করে আবার আঙুলে পরবেন। চোর সেই নীলাটাও নিয়ে গিয়েছিল।

‘নীলা সম্বন্ধে তুমি কিছু জোন কি না বলতে পারি না। নীলা জিনিসটা হীরে‌, তবে নীল হীরে। অন্যান্য হীরের মত কিন্তু কেবল ওজনের ওপরই এর দাম হয় না; অধিকাংশ সময়–অন্তত আমাদের দেশে–নীলার দাম ধাৰ্য হয় এর দৈবশক্তির ওপর। নীলা হচ্ছে শনিগ্রহের পাথর। এমন অনেক শোনা গেছে যে পয়মস্ত নীলা ধারণ করে কেউ কোটিপতি হয়ে গেছে‌, আবার কেউ বা রাজা থেকে ফকির হয়ে গেছে। নীলার প্রভাব কখনও শুভ কখনও বা ঘোর অশুভ।

0 Shares