রক্তমুখী নীলা

‘একই নীলা যে সকলের কাছে সমান ফল দেবে তার কোনও মানে নেই। একজনের পক্ষে যে নীলা মহা শুভকর‌, অন্যের পক্ষে সেই নীলাই সর্বনেশে হতে পারে। তাই নীলার দাম তার ওজনের ওপর নয়। বিশেষত রক্তমুখী নীলার। পাঁচ রতি ওজনের একটি নীলার জন্যে আমি একজন মাড়োয়ারীকে এগারো হাজার টাকা দিতে দেখেছি। লোকটা যুদ্ধের বাজারে চিনি আর লোহার ব্যবসা করে ডুবে গিয়েছিল‌, তারপর-; কিন্তু সে গল্প আর একদিন বলব। আমি কুসংস্কারাচ্ছন্ন গোঁড়া হিন্দু নই‌, ভূত-প্ৰেত মারণ-উচাটন বিশ্বাস করি না। কিন্তু রক্তমুখী নীলার অলৌকিক শক্তির উপর আমার অটল বিশ্বাস।

‘সে যাক‌, যা বলছিলুম। মহারাজ রমেন্দ্ৰ সিংহের নীলা চুরি যাওয়াতে তিনি মহা হৈ চৈ বাধিয়ে দিলেন। তাঁর প্রায় পাঁচশ ত্ৰিশ হাজার টাকার মণি-মুক্তো চুরি গিয়েছিল। কিন্তু তাঁর কাছে নীলাটা যাওয়াই সবচেয়ে মমস্তিক। তিনি ঘোষণা করে দিলেন যে চোর ধরা পড়ুক আর না পাডুক‌, তাঁর নীলা যে ফিরিয়ে এনে দিতে পারবে‌, তাকে তিনি দু’হাজার টাকা পুরস্কার দেবেন। পুলিস তো যথাসাধ্য করছিলই‌, এখন আরও উঠে পড়ে লেগে গেল। পুলিসের সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা নির্মলবাবু তদন্তের ভার গ্রহণ করলেন।

‘নির্মলবাবুর নাম বোধ হয় তুমি শোননি‌, সত্যিই বিচক্ষণ লোক। তাঁর সঙ্গে আমার সামান্য পরিচয় ছিল‌, এখন তিনি রিটায়ার করেছেন। যা হোক‌, নির্মলবাবু তদন্ত হাতে নেবার সাত দিনের মধ্যেই জহরত-চোর ধরা পড়ল। চোর আর কেউ নয়–এই রমানাথ নিয়োগী। তার বাড়ি খানাতল্লাস করে সমস্ত চোরাই মাল বেরুল‌, কেবল সেই রক্তমুখী নীলাটা পাওয়া গেল না।

‘তারপর যথাসময়ে বিচার শেষ হয়ে রমানাথ বারো বছরের জন্যে জেলে গেল। কিন্তু নীলার সন্ধান তখনও শেষ হল না। রমানাথ কোনও স্বীকারোক্তি করলে না‌, শেষ পর্যন্ত মুখ টিপে রইল। ওদিকে মহারাজ রমেন্দ্ৰ সিংহ পুলিসের পিছনে লেগে রইলেন। পুরস্কারের লোভে পুলিস অনুসন্ধান চালিয়ে চলল।

‘রমানাথ জেলে যাবার মাস তিনেক পরে নির্মলবাবু খবর পেলেন যে নীলাটা রমনাথের কাছেই আছে‌, কয়েকজন কয়েদী নাকি দেখেছে। জেলে পুলিসের গুপ্তচর কয়েদীর ছদ্মবেশে থাকে তা তো জান‌, তারাই খবর দিয়েছে। খবর পেয়ে নির্মলবাবু হঠাৎ একদিন রমানাথের ‘সেলে গিয়ে খানাতল্লাস করলেন‌, কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না। রমানাথ তখন আলিপুর জেলে ছিল‌, কোথায় যে নীলাটা সরিয়ে ফেললে কেউ খুঁজে বার করতে পারলে না।

‘সেই থেকে নীলাটা একেবারে লোপাট হয়ে গেছে। পুলিস অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে হল ছেড়ে দিয়েছে-?

ব্যোমকেশ কিয়ৎকাল চুপ করিয়া বসিয়া রহিল; তারপর কতকটা যেন নিজ মনেই বলিল‌, ‘মন্দ প্রবলেম নয়। এলাচের মত একটা নীল রঙের পাথর-একজন জেলের কয়েদী সেটা কোথায় লুকিয়ে রাখলে! কেসটা যদি আমার হাতে আসত চেষ্টা করে দেখতুম। দু’হাজার টাকা পুরস্কারও ছিল—’

ব্যোমকেশের অর্ধ স্বগতোক্তি ব্যাহত করিয়া সিঁড়ির উপর পদশব্দ শোনা গেল। আমি সোজা হইয়া উঠিয়া বসিয়া বলিলাম‌, ‘লোক আসছে। ব্যোমকেশ‌, বোধ হয় মক্কেল।’

ব্যোমকেশ কান পাতিয়া শুনিয়া বলিল‌, ‘বুড়ো লোক‌, দামী জুতো-এই বর্ষাতেও মচমচ করছে; সম্ভবত গাড়িমোটরে ঘুরে বেড়ান‌, সুতরাং বড় মানুষ। একটু খুঁড়িয়ে চলেন।’—হঠাৎ উত্তেজিত স্বরে বলিয়া উঠিল‌, ‘অজিত‌, তাও কি সম্ভব? জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে দেখ তো প্রকাণ্ড একখানা রোলস রয়েস সামনে দাঁড়িয়ে আছে কিনা-আছে। ঠিক ধরেছি তাহলে। কি আশ্চর্য যোগাযোগ‌, অজিত! যাঁর কথা হচ্ছিল। সেই মহারাজ রমেন্দ্ৰ সিংহ আসছেন–কেন আসছেন জান?’

আমি সোৎসাহে বলিলাম‌, ‘জানি‌, খবরের কাগজে পড়েছি। তাঁর সেক্রেটারি হরিপদ রক্ষিত সম্প্রতি খুন হয়েছে–সেই বিষয়ে হয়তো—’

দ্বারে টোকা পড়িল।

দ্বার খুলিয়া ব্যোমকেশ আসুন মহারাজ বলিয়া যে লোকটিকে সসন্ত্ৰমে আহ্বান করিল‌, সাময়িক কাগজ-পত্রে তাঁহার অনেক ছবি দেখিয়া থাকিলেও আসল মানুষটিকে এই প্রথম চাক্ষুষ করিলাম। সঙ্গে লোকলিস্করের আড়ম্বর নাই—অত্যন্ত সাদাসিধা ধরনের মানুষ; ঈষৎ রুগ্ন ক্ষীণ চেহারা–পায়ের একটা দোষ থাকাতে একটু খোঁড়াইয়া চলেন। বয়স বোধ করি ষাট পার হইয়া গিয়াছে; কিন্তু বার্ধক্যের লোলচর্ম তাঁহার মুখখানিকে কুৎসিত করিতে পারে নাই–বরং একটি স্নিগ্ধ প্রসন্নতা মুখের জরাজনিত বিকারকে মহিমান্বিত করিয়া তুলিয়াছে।

মহারাজ একটু হাসিয়া ব্যোমকেশের মুখের পানে চাহিলেন‌, তাঁহার দৃষ্টিতে ঈষৎ বিস্ময়ও প্ৰকাশ পাইল। বলিলেন‌, ‘আপনার ভাব দেখে মনে হচ্ছে‌, আপনি আমার প্রতীক্ষা করছিলেন। আমি আসব সেটা কি আগে থাকতে অনুমান করে রেখেছিলেন নাকি?’

ব্যোমকেশও হাসিল। ‘এত বড় সৌভাগ্য আমি কল্পনা করতেও পারিনি। কিন্তু আপনার সেক্রেটারির মৃত্যুর কোন কিনারাই যখন পুলিস করতে পারল না‌, তখন আশা হয়েছিল হয়তো মহারাজ স্মরণ করবেন। কিন্তু আসুন‌, আগে বসুন।’

মহারাজ চেয়ারে উপবেশন করিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ‌, আজ পাঁচ দিন হয়ে গেল‌, পুলিস তো কিছুই করতে পারলে না; তাই ভাবলুম দেখি যদি আপনি কিছু করতে পারেন। হরিপদর ওপর আমার একটা মায়া জন্মে গিয়েছিল—তা ছাড়া তার মৃত্যুর ধরণটাও এমন ভয়ঙ্কর–’ মহারাজ একটু থামিলেন—‘অবশ্য সে সাধু লোক ছিল না; কিন্তু আপনারা তো জানেন‌, ঐরকম লোককে সৎপথে আনবার চেষ্টা করা আমার একটা খেয়াল। আর‌, সব দিক দিয়ে দেখতে গেলে হরিপদ নেহাত মন্দ লোক ছিল না। কাজকর্ম খুবই ভাল করত; আর কৃতজ্ঞতাও যে তার অন্তরে ছিল। সে প্রমাণও আমি অনেকবার পেয়েছি।’

0 Shares