রক্তমুখী নীলা

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘মাপ করবেন‌, হরিপদবাবু সাধু লোক ছিলেন না‌, এ খবর তো জানতুম না। তিনি কোন দুষ্কার্য করেছিলেন?’

মহারাজ বলিলেন‌, ‘সাধারণে যাকে দাগী আসামী বলে‌, সে ছিল তাই। অনেকবার জেলা খেটেছিল। শেষবার জেল থেকে বেরিয়ে যখন আমার কাছে–’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘দয়া করে সব কথা গোড়া থেকে বলুন। খবরের কাগজের বিবরণ আমি পড়েছি বটে‌, কিন্তু তা এত অসম্পূর্ণ যে‌, কিছুই ধারণা করা যায় না। আপনি মনে করুন‌, আমরা কিছুই জানি না। সব কথা আপনার মুখে স্পষ্টভাবে শুনলে ব্যাপারটা বোঝবার সুবিধা হবে।’

মহারাজ বলিলেন‌, ‘বেশ‌, তাই বলছি।’ তারপর গলাটা ঝাড়িয়া লইয়া আস্তে আস্তে বলিতে আরম্ভ করিলেন‌, ‘আন্দাজ মাস ছয়েকের কথা হবে; ফায়ুন মাসের মাঝামাঝি হরিপদ প্রথম আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। আগের দিন জেল থেকে বেরিয়েছে‌, আমার কাছে কোন কথাই গোপন করলে না। বললে‌, আমি যদি তাকে সৎপথে চলাবার একটা সুযোগ দিই‌, তাহলে সে আর বিপথে যাবে না। তাকে দেখে তার কথা শুনে দয়া হল। বয়স বেশি নয়‌, চল্লিশের নীচেই‌, কিন্তু এরি মধ্যে বার চারেক জেল খেটেছে। শেষবারে চুরি‌, জালিয়াতি‌, নাম ভাঁড়িয়ে পরের দস্তখতে টাকা নেওয়া ইত্যাদি কয়েকটা গুরুতর অপরাধে লম্বা মেয়াদ খেটেছে। দেখলুম‌, অনুতাপও হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলুম‌, কি কাজ করতে পার? বললে‌, লেখাপড়া বেশি শেখবার অবকাশ পাইনি, উনিশ বছর থেকে ক্রমাগত জেলই খাটছি। তবু নিজের চেষ্টায় সর্টহ্যান্ড টাইপিং শিখেছি; যদি দয়া করে আপনি নিজের কাছে রাখেন‌, প্ৰাণ দিয়ে আপনার কাজ করব।

‘হরিপদকে প্রথম দেখেই তার ওপর আমার একটা মায়া জন্মেছিল; কি জানি কেন‌, ঐ জাতীয় লোকের আবেদন আমি অবহেলা করতে পারি না। তাই যদিও আমার সর্টহ্যান্ড টাইপিস্টের দরকার ছিল না‌, তবু পঞ্চাশ টাকা মাইনে দিয়ে তাকে নিজের কাছে রাখলুম। তার আত্মীয়-স্বজন কেউ ছিল না। কাছেই একখানা ছোট বাসা ভাড়া করে থাকতে লাগিল।

‘কিছুদিনের মধ্যেই দেখলুম‌, লোকটি অসাধারণ কর্মপটু আর বুদ্ধিমান; যে কাজ তার নিজের নয়। তাও এমন সুচারুভাবে করে রাখে যে কারুর কিছু বলবার থাকে না। এমন কি‌, ভবিষ্যতে আমার কি দরকার হবে তা আগে থাকতে আন্দাজ করে তৈরি করে রাখে। মােস দুই যেতে না যেতেই সে আমার কাছে একেবারে অপরিহার্য হয়ে উঠল। হরিপদ না হলে কোন কাজই চলে कीं।

‘এই সময় আমার প্রাচীন সেক্রেটারি অবিনাশবাবু মারা গেলেন। আমি তাঁর জায়গায় হরিপদকে নিযুক্ত করলুম। এই নিয়ে আমার আমলাদের মধ্যে একটু মন কষাকষিও হয়েছিল–কিন্তু আমি সে সব গ্রাহ্য করিনি। সবচেয়ে উপযুক্ত লোক বুঝেই হরিপদকে সেক্রেটারির পদ দিয়েছিলুম।

‘তারপর গত চার মাস ধরে হরিপদ খুব দক্ষতার সঙ্গেই সেক্রেটারির কাজ করে এসেছে‌, কখনও কোন ত্রুটি হয়নি। নিম্নতন কর্মচারীরা মাঝে মাঝে আমার কাছে তার নামে নালিশ করত‌, কিন্তু সে সব নিতান্তই বাজে নালিশ। হরিপদর নামে কলঙ্ক পড়েছিল বটে-জেলের দাগ সহজে মোছে না-কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার চরিত্র যে একেবারে বদলে গিয়েছিল‌, তাতে সন্দেহ নেই। আমার মনে হয় অভাবের তাড়নায় সে অসৎপথে গিয়েছিল‌, তাই অভাব দূর হবার সঙ্গে সঙ্গে তার দুগ্ধপ্রবৃত্তিও কেটে গিয়েছিল। আমাদের জেলখানা খুঁজলে এই ধরনের কত লোক যে বেরোয় তার সংখ্যা নেই।

‘সে যা হোক‌, হঠাৎ গত মঙ্গলবারে যে ব্যাপার ঘটল তা একেবারে অভাবনীয়। খবরের কাগজে অল্পবিস্তর বিবরণ আপনারা পড়েছেন‌, তাতে যোগ করবার আমার বিশেষ কিছু নেই। সকালবেলা খবর পেলুম হরিপদ খুন হয়েছে। পুলিসে খবর পাঠিয়ে নিজে গেলুম তার বাসায়। দেখলুম‌, শোবার ঘরের মেঝোয় সে মরে পড়ে আছে; রক্তে চারিদিক ভেসে যাচ্ছে। হত্যাকারী তার গলাটা এমন ভয়ঙ্করভাবে কেটেছে যে ভাবতেও আতঙ্ক হয়। গলার নলী কেটে চিরে একেবারে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। আপনারা অনেক হত্যাকাণ্ড নিশ্চয় দেখেছেন‌, কিন্তু এমন পাশবিক নৃশংসতা। কখনও দেখেছেন বলে বোধ হয় না।’

এই পর্যন্ত বলিয়া মহারাজ যেন সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা পুনরায় প্রত্যক্ষ করিয়া শিহরিয়া চক্ষু মুদিলেন।

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘তার দেহে আর কোথাও আঘাত ছিল না?’

মহারাজ বলিলেন‌, ‘ছিল। তার বুকে ছুরির একটা আঘাত ছিল। ডাক্তার বলেন‌, ঐ আঘাতই মৃত্যুর কারণ। গলার আঘাতগুলো তার পরের। অর্থাৎ‌, হত্যাকারী প্রথমে তার বুকে ছুরি মেরে তাকে মমন্তিক আহত করে‌, তারপর তার গলা ঐ ভাবে ছিন্নভিন্ন করেছে। কি ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা‌, ভাবুন তো? আমি শুধু ভাবি‌, কি উন্মত্ত আক্রোশের বশে মানুষ তার মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে এমন হিংস্ৰ জন্তুতে পরিণত হয়।’

কিছুক্ষণ আর কোনও কথা হইল না। মহারাজ বোধ করি মনুষ্য নামক অদ্ভুত জীবের অমানুষিক দুস্কৃতি করিবার অফুরন্ত শক্তির কথাই ভাবিতে লাগিলেন। ব্যোমকেশ ঘাড় হেঁট করিয়া চিন্তামগ্ন হইয়া রহিল।

সহসা ব্যোমকেশের অর্ধ-মুদিত চোখের দিকে আমার নজর পড়িল। সঙ্গে সঙ্গে আমিও উত্তেজিত হইয়া উঠিলাম—সেই দৃষ্টি! বহুবার দেখিয়াছি‌, ভুল হইবার নয়।

ব্যোমকেশ কোথাও একটা সূত্র পাইয়াছে।

মহারাজ অবশেষে মৌনভঙ্গ করিয়া বলিলেন‌, ‘আমি যা জানি আপনাকে বললুম। এখন আমার ইচ্ছে‌, পুলিস যা পারে করুক‌, সেই সঙ্গে আপনিও আমার পক্ষ থেকে কাজ করুন। এতবড় একটা নৃশংস হত্যাকারী যদি ধরা না পড়ে‌, তাহলে সমাজের পক্ষে বিশেষ আশঙ্কার কথা–আপনার কোন আপত্তি নেই তো?’

0 Shares