রক্তমুখী নীলা

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কিছু না। পুলিসের সঙ্গে আমার ঝগড়া নেই‌, বরঞ্চ বিশেষ প্রণয় আছে। আপত্তি কিসের?–আচ্ছা‌, হরিপদ শেষবার ক’বছর জেল খেটেছিল আপনি জানেন?’

মহারাজ বলিলেন‌, ‘হরিপদর মুখেই শুনেছিলুম‌, আইনের কয়েক ধারা মিলিয়ে তার চৌদ্দ বছর। জেল হয়েছিল; কিন্তু জেলে শাস্তশিষ্ট ভাবে থাকলে কিছু সাজা মাপ হয়ে থাকে‌, তাই তাকে এগারো বছরের বেশি খাটতে হয়নি।’

ব্যোমকেশ প্রফুল্লভাবে বলিল‌, ‘বেশ চমৎকার! হরিপদ সম্বন্ধে আপনি আর কিছু বলতে পারেন না?’

মহারাজ বলিলেন‌, ‘আপনি ঠিক কোন ধরনের কথা জানতে চান বলুন‌, দেখি যদি বলতে পারি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘মৃত্যুর দু-চার দিন আগে তার আচার-ব্যবহারে এমন কিছু লক্ষ্য করেছিলেন। কি‌, যা ঠিক স্বাভাবিক নয়?’

মহারাজ বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ‌, লক্ষ্য করেছিলুম। মৃত্যুর তিন-চার দিন আগে একদিন সকালবেলা হরিপদ আমার কাছে বসে কাজ করতে করতে হঠাৎ অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার ভাব দেখে আমার মনে হয়েছিল যে‌, কোন কারণে সে ভারি ভয় পেয়েছে।’

‘সে সময় আর কেউ আপনার কাছে ছিল না?’

মহারাজ একটু ভাবিয়া বলিলেন‌, ‘সে সময় কতকগুলি ভিক্ষার্থীর আবেদন আমি দেখছিলুম। যতদূর মনে পড়ে‌, একজন ভিক্ষার্থী তখন সেখানে উপস্থিত ছিল।’

‘তার সামেনই হরিপ অসুস্থ হয়ে পড়ে?’

‘হ্যাঁ’।

একটু নীরব থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘যাক। আর কিছু? অন্য সময়ের কোন বিশেষ ঘটনা স্মরণ করতে পারেন না?’

মহারাজ প্ৰায় পাঁচ মিনিট গালে হাত দিয়া বসিয়া চিন্তা করিলেন‌, তারপর বলিলেন‌, ‘একটা সামান্য কথা মনে পড়ছে। নিতান্তই অবাস্তর ঘটনা‌, তবু বলছি আপনার যদি সাহায্য হয়। আপনি বোধ হয় জানেন না‌, কয়েক বছর আগে আমার বাড়ি থেকে একটা দামী নীলা চুরি যায়—’

‘জানি বৈকি।’

‘জানেন? তাহলে এও নিশ্চয় জানেন যে‌, সেই নীলাটা ফিরে পাবার জন্যে আমি দু’হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলুম?’

‘তাও জানি। তবে সে ঘোষণা এখনও বলবৎ আছে কিনা জানি না।’

মহারাজ বলিলেন‌, ‘ঠিক ঐ প্রশ্নই হরিপদ করেছিল। তখন সে আমার টাইপিস্ট‌, সবে মাত্র কাজে ঢুকেছে। একদিন হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলে‌, ‘মহারাজ‌, আপনার যে নীলাটা চুরি গিয়েছিল‌, সেটা এখন ফিরে পেলে কি আপনি দু’হাজার টাকা পুরস্কার দেবেন? তার প্রশ্নে কিছু আশ্চর্য হয়েছিলাম; কারণ এতদিন পরে নীলা ফিরে পাবার আর কোনও আশাই ছিল না‌, পুলিস আগেই হল ছেড়ে দিয়েছিল।’

‘আপনি হরিপদর প্রশ্নের কি উত্তর দিয়েছিলেন?’

‘বলেছিলুম‌, যদি নীলা ফিরে পাই নিশ্চয়ই দেব।’

ব্যোমকেশ তাড়াক করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল‌, ‘মহারাজ‌, আমি যদি আজ ঐ প্রশ্ন করি‌, তাহলে কি সেই উত্তরই দেবেন?’

মহারাজ কিছুক্ষণ অবাক হইয়া তাকাইয়া থাকিয়া বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ‌, নিশ্চয়। কিন্তু–’

ব্যোমকেশ আবার বসিয়া পড়িয়া বলিল‌, ‘আপনি হরিপদর হত্যাকারীর নাম জানতে চান?

মহারাতের হতবুদ্ধি ভাব আরও বর্ধিত হইল, তিনি বলিলেন, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি হরিপদর হত্যাকারীর নাম জানেন নাকি?’

‘জানি‌, তবে তার বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্ৰহ করা আমার কাজ নয়—সে কাজ পুলিস করুক। আমি শুধু তার নাম বলে দেব; তারপর তার বাড়ি তল্লাস করে প্রমাণ বার করা বোধ হয় শক্ত হবে না।’

অভিভূত কষ্ঠে মহারাজ বলিলেন‌, ‘কিন্তু এ যে ভেল্কিবাজির মত মনে হচ্ছে। সত্যিই আপনি তার নাম জানেন? কি করে জানলেন?’

‘আপাতত অনুমান মাত্র। তবে অনুমান মিথ্যে হবে না। হত্যাকারীর নাম হচ্ছে—রমানাথ নিয়োগী।’

‘রমানাথ নিয়োগী! কিন্তু–কিন্তু নামটা পরিচিত মনে হচ্ছে।’

‘হবারই তো কথা। বছর দশেক আগে ইনিই আপনার নীলা চুরি করে জেলে গিয়েছিলেন, সম্প্রতি জেল থেকে বেরিয়েছেন।’

‘মনে পড়েছে। কিন্তু সে হরিপদকে খুন করলে কেন? হরিপদর সঙ্গে তার কি সম্বন্ধ?’

‘সম্বন্ধ আছে—পুরনো কয়েকটা নথি ঘাঁটলেই সেটা বেরুবে। কিন্তু মহারাজ, বেলা প্রায় এগারটা বাজে, আর আপনাকে ধরে রাখব না। বিকেলে চারটের সময় যদি দয়া করে আবার পায়ের ধুলো দেন তাহলে সব জানতে পারবেন। আর হয়তো নীলাটাও ফিরে পেতে পারেন। আমি ইতিমধ্যেই সব ব্যবস্থা করে রাখব।’

হতভম্ব মহারাজকে বিদায় দিয়া ব্যোমকেশ নিজেও বাহির হইবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিল, জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এত বেলায় তুমি আবার কোথায় চললে?’

সে বলিল, “বেরুতে হবে। জেলের কিছু পুরনো কাগজপত্র দেখা দরকার। তাছাড়া অন্য কাজও আছে। কখন ফিরব কিছু ঠিক নেই। যদি সময় পাই, হোটেলে খেয়ে নেব। ’ বলিয়া ছাতা ও বযাতি লইয়া বিরামহীন বৃষ্টির মধ্যে বাহির হইয়া পড়িল।

যখন ফিরিয়া আসিল, তখন বেলা তিনটা। জামা, জুতা খুলিতে খুলিতে বলিল, ‘বেজায় ক্ষিদে পেয়েছে, কিছু খাওয়া হয়নি। স্নান করে নিই। পুঁটিরাম, চট্ট করে কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা কর। —আজি ম্যাটিনি-ঠিক চারটের সময় অভিনয় আরম্ভ হবে।’

বিস্মিতভাবে বলিলাম, ‘সে কি ! কিসের অভিনয়?’

ব্যোমকেশ বলিল, “ভয় নেই—এই ঘরেই অভিনয় হবে। অজিত, দর্শকের জন্যে আরও গোটাকয়েক চেয়ার এ ঘরে আনিয়া রাখা।’ বলিয়া স্নান-ঘরে ঢুকিয়া পড়িল।

স্নানান্তে আহার করিতে বসিলে বলিলাম, ‘সমস্ত দিন কি করলে বল।’

ব্যোমকেশ অনেকখানি আমলেট মুখে পুরিয়া দিয়া তৃপ্তির সহিত চিবাইতে চিবাইতে বলিল, ‘জেল ডিপার্টমেন্টের অফিসে আমার এক বন্ধু আছেন, প্রথমে তাঁর কাছে গেলুম। সেখানে পুরনো রেকর্ড বার করে দেখা গেল যে, আমার অনুমান ভুল হয়নি।’

0 Shares