‘তোমার অনুমানটা কি?’
প্রশ্নে কর্ণপাত না করিয়া ব্যোমকেশ বলিতে লাগিল, ‘সেখানকার কাজ শেষ করে বুদ্ধুবাবু—থুড়ি—বিধুবাবুর কাছে গেলুম। হরিপদর খুনটা তাঁরই এলাকায় পড়ে। কেসের ইনচার্জ হচ্ছেন ইন্সপেক্টর পূর্ণবাবু। পূৰ্ণবাবুকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে এবং বিধুবাবুর পদদ্বয়ে যথােচিত তৈল প্রয়োগ করে শেষ পর্যন্ত কযোদ্ধার হল।’
‘কিন্তু কাৰ্যটা কি তাই যে আমি এখনও জানি না।’
‘কার্যটা হচ্ছে প্রথমত রমানাথ নিয়োগীর ঠিকানা বার করা এবং দ্বিতীয়ত তাকে গ্রেপ্তার করে তার বাসা খানাতল্লাস করা। ঠিকানা সহজেই বেরুল, কিন্তু খানাতল্লাসে বিশেষ ফল হল না। অবশ্য রমানাথের ঘর থেকে একটা ভীষণাকৃতি ছোরা বেরিয়েছে ; তাতে মানুষের রক্ত পাওয়া যায় কি না পরীক্ষার জন্যে পাঠান হয়েছে। কিন্তু যে জিনিস পাব আশা করেছিলুম তা পেলুম। না। লোকটার লুকিয়ে রাখবার ক্ষমতা অসামান্য।’
‘কি জিনিস?’
‘মহারাজের নীলাটা।‘
‘তারপর? এখন কি করবে?’
‘এখন অভিনয় করব। রমনাথের কুসংস্কারে ঘা দিয়ে দেখব। যদি কিছু ফল পাই—ঐ বোধ হয় মহারাজ এলেন। বাকি অভিনেতারাও এসে পড়ল বলে।’ বলিয়া ঘড়ির দিকে তাকাইল।
‘আর কারা আসবে?’
‘রমানাথ এবং তার রক্ষীরা।’
‘তারা এখানে আসবে?’
‘হ্যাঁ, বিধুবাবুর সঙ্গে সেই রকম ব্যবস্থাই হয়েছে। —পুঁটিরাম, খাবারের বাসনগুলো সরিয়ে নিয়ে যাও।’
আর কিছু জিজ্ঞাসা করিবার অবসর পাইলাম না, মহারাজ আসিয়া প্রবেশ করিলেন। ঘড়িতে ঠং ঠেং করিয়া চরিটা বাজিল! দেখিলাম, মহারাজ রাজ্যোচিত শিষ্টতা রক্ষা করিয়াছেন।
মহারাজকে সমাদর করিয়া বসাইতে না বসাইতে আরও কয়েকজনের পদশব্দ শুনা গেল। পরীক্ষণেই বিধুবাবু্, পূৰ্ণবাবু ও আরও দুইজন সাব-ইন্সপেক্টরের সঙ্গে রমনাথ প্রবেশ করিল।
রমানাথের চেহারায় এমন কোন বিশেষত্ব নাই যাহা দৃষ্টি আকর্ষণ করে; চুরি বিদ্যায় পারদশী হইতে হইলে বোধহয় চেহারাটি নিতান্ত চলনসই হওয়া দরকার। রমানাথের মাথায় ছোট করিয়া চুল ছাঁটা, কপাল অপরিসর, চিবুক ছুঁচালো–চোখে সতর্ক চঞ্চলতা। তাহার গায়ে বহু বৎসরের পুরাতন (সম্ভবত জেলে যাইবার আগেকার) চামড়ার বোতাম আটা পাঁচ মিশালি রঙের স্পোর্টিং কোট ও পায়ে অপ্রত্যাশিত একজোড়া রবারের বুট জুতা দেখিয়া সহসা হাস্যরসের উদ্রেক হয়। ইনি যে একজন সাংঘাতিক ব্যক্তি সে সন্দেহ কাহারও মনে উদয় হয় না।
ব্যোমকেশ অঙ্গিলি নির্দেশে তাহাকে দেখাইয়া বলিল, ‘মহারাজ, লোকটিকে চিনতে পারেন কি?’
মহারাজ বলিলেন, ‘হ্যাঁ, এখন চিনতে পারছি। এই লোকটাই সেদিন ভিক্ষে চাইতে গিয়েছিল।’
‘বেশ। এখন তাহলে আপনারা সকলে আসন গ্রহণ করুন। বিধুবাবু্, মহারাজের সঙ্গে নিশ্চয় পরিচয় আছে। আসুন, আপনি মহারাজের পাশে বসুন। রমনাথ, তুমি এইখানে বস।’ বলিয়া ব্যোমকেশ রমানাথকে টেবিলের ধারে একটা চেয়ার নির্দেশ করিয়া দিল।
রমানাথ বাঙনিস্পত্তি না করিয়া উপবেশন করিল। দুই জন সাব-ইন্সপেক্টর তাহার দুই পাশে বসিলেন। বিধুবাবু অভ্ৰভেদী গাম্ভীর্য অবলম্বন করিয়া কটমট করিয়া চারিদিকে তাকাইতে লাগিলেন। এই সম্পূর্ণ আইন-বিগৰ্হিত ব্যাপার ঘটিতে দিয়া তিনি যে ভিতরে ভিতরে অতিশয় অস্বস্তি বোধ করিতেছেন তাহা তাঁহার ভাবভঙ্গীতে প্ৰকাশ পাইতে লাগিল।
সকলে উপবিষ্ট হইলে ব্যোমকেশ টেবিলের সম্মুখে বসিল। বলিল, ‘আজ আমি আপনাদের একটা গল্প বলব। অজিতের গল্পের মত কাল্পনিক গল্প নয়-সত্য ঘটনা। যতদূর সম্ভব নির্ভুল ভাবেই বলবার চেষ্টা করব; যদি কোথাও ভুল হয়, রমানাথ সংশোধন করে দিতে পারবে। রমানাথ ছাড়া আর একজন। এ কাহিনী জানত, কিন্তু আজ সে বেঁচে নেই।’
এইটুকু ভূমিকা করিয়া ব্যোমকেশ তাহার গল্প আরম্ভ করিল। রমানাথের মুখ কিন্তু নির্বিকার হইয়া রহিল। সে মুখ তুলিল না, একটা কথা বলিল না, নির্লিপ্তভাবে আঙ্গুল দিয়া টেবিলের উপর দাগ কাটিতে লাগিল।
‘রমানাথ জেলে যাবার পর থেকেই গল্প আরম্ভ করছি। রমানাথ জেলে গেল, কিন্তু মহারাজের নীলাটা সে কাছছাড়া করলে না, সঙ্গে করে নিয়ে গেল। কি কৌশলে সকলের সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে নিয়ে গেল-তা আমি জানি না, জািনবার চেষ্টাও করিনি। রমানাথ ইচ্ছে করলে বলতে পারে।’
পলকের জন্য রমনাথ ব্যোমকেশের মুখের দিকে চোখ তুলিয়াই আবার নিবিষ্ট মনে টেবিলে দাগ কাটিতে লাগিল।
ব্যোমকেশ বলিতে লাগিল, ‘রামানাথ অনেক ভাল ভাল দামী জহরত চুরি করেছিল; কিন্তু তার মধ্যে থেকে কেবল মহারাজের রক্তমুখী নীলাটাই যে কেন সঙ্গে রেখেছিল তা অনুমান করাই দুষ্কর। সম্ভবত পাথরটার একটা সম্মোহন শক্তি, ছিল; জিনিসটা দেখতেও চমৎকার-গাঢ় নীল রঙের একটা হীরা, তার ভেতর থেকে রক্তের মত লাল রঙ ফুটে বেরুচ্ছে। রমানাথ সেটাকে সঙ্গে নেবার লোভ সামলাতে পারেনি। পাথরটা খুব পয়মন্ত একথাও সম্ভবত রমানাথ শুনেছিল। দুর্নিয়তি যখন মানুষের সঙ্গ নেয়, তখন মানুষ তাকে বন্ধু বলেই ভুল করে।
‘যা হোক, রমানাথ আলিপুর জেলে রইল। কিছুদিন পরে পুলিস জানতে পারল যে, নীলাটা তার কাছেই আছে। যথাসময়ে রমানাথের ‘সেল খানাতল্লাস হল। রমানাথের সেলে আর একজন কয়েদী ছিল, তাকেও সার্চ করা হল। কিন্তু নীলা পাওয়া গেল না। কোথায় গেল নীলাটা?
‘রমানাথের সেলে যে দ্বিতীয় কয়েদী ছিল তার নাম হরিপদ রক্ষিত। হরিপদ পুরনো ঘাগী আসামী, ছেলেবেলা থেকে জেল খেটেছে–তার অনেক গুণ ছিল। যাঁরা জেলের কয়েদী নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন তাঁরাই জানেন, এক জাতীয় কয়েদী আছে যারা নিজেদের গলার মধ্যে পকেট তৈরি করে। ব্যাপারটা শুনতে খুবই আশ্চর্য কিন্তু মিথ্যে নয়। কয়েদীরা টাকাকড়ি জেলে নিয়ে যেতে পারে না; অথচ তাদের মধ্যে বেশির ভাগই নেশাখের। তাই, ওয়াডারদের ঘুষ দিয়ে বাইরে থেকে মাদকদ্রব্য আনাবার জন্যে টাকার দরকার হয়। গলায় পকেট তৈরি করবার ফন্দি এই প্রয়োজন থেকেই উৎপন্ন হয়েছে; যারা কাঁচা বয়স থেকে জেলে আছে তাদের মধ্যেই এ জিনিসটা বেশি দেখা যায়। প্রবীণ পুলিস কর্মচারী মাত্রই এসব কথা জানেন।