রুম নম্বর দুই

নিরুপমা হোটেলের ম্যানেজার হরিশচন্দ্র হোড় ঘুম ভেঙেই ঘড়ি দেখলেন–সাড়ে‌, ছটা। তিনি ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলেন। ইঃ‌, আজ বেজায় দেরি হয়ে গেছে। তিনি ডাকলেন‌, ‘গুণধর!’

তকমা-উর্দি পর সদর খানসামা গুণধর এসে দাঁড়াল। শীর্ণকান্তি অত্যন্ত কর্মকুশল চৌকশ লোক, হোটেলের প্রত্যেকটি খুঁটিনাটির প্রতি নজর আছে। হরিশচন্দ্র তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বেড-টি দেওয়া হয়েছে?’

গুণধর বলল‌, ‘আজ্ঞে। তেতলার সবাই চা নিয়েছেন‌, কেবল দোতলার দুনম্বর ঘরে টোকা দিয়ে সাড়া পেলাম না।’

হরিশচন্দ্র বললেন‌, ‘দোতলার দু’নম্বর–রাজকুমারবাবু। পনেরো মিনিট পরে আবার টোকা দিও।–বাজারে কে গেছে?’

‘জেনারেলকে নিয়ে সরকার মশায় গেছেন।’

‘বেশ। আমার চা নিয়ে এস।’ হরিশচন্দ্র উঠে কক্ষ-সংলগ্ন বাথরুমে প্রবেশ করলেন।

রাসবিহারী অ্যাভেন্ম ও গড়িয়াহাটার চৌমাথা থেকে অনতিদূরে নিরুপমা হোটেল। দেশী হোটেল হলেও তার ভাবভঙ্গী একটু বিলিতি-ঘেষা। চাকরেরা খানসামার মত তকমা-উর্দি পারে‌, সদর দরজার সামনে সকাল বিকেল জেনারেলের মত সাজপোশাক পরা দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকে এবং যোগ্য ব্যক্তিকে সেলাম করে। তিনতলা বাড়ির প্রত্যেক তলায় আটখানি ঘর। নীচের তলায় ম্যানেজারের দু’টি ঘর‌, বাসকক্ষ ও অফিস; টেবিল চেয়ার দিয়ে সাজানো ডাইনিং রুম; রান্নাঘর‌, বাবুর্চিখানা‌, চাকরদের ঘর‌, স্টোর-রুম ইত্যাদি। হোটেলে দেশী ও বিলিতি দুরকম খাদ্যই পাওয়া যায়‌, যার যেমন ইচ্ছা খেতে পারেন। হোটেলে থাকার মাশুল বিলিতি হোটেলের চেয়ে কম‌, কিন্তু সাধারণ দেশী হোটেলের চেয়ে বেশি। ছোট হোটেল‌, তাই অধিকাংশ সময়ই পূর্ণ থাকে‌, উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অতিথি এখানে আসেন।

আধঘণ্টা পরে হরিশচন্দ্র বাথরুম থেকে বিলিতি পোশাক পরে বেরুলেন। দোহারা আকৃতির লোক‌, তাই কোট-প্যান্ট পরলে বেশ মানায়; বয়স আন্দাজ পায়তাল্লিশ‌, চোখের দৃষ্টিতে অভিজ্ঞতা এবং সংসারবুদ্ধি পরিস্ফুট।

টেবিলের ওপর চা এবং প্রাতরাশ সাজিয়ে গুণধর দাঁড়িয়ে ছিল‌, হরিশচন্দ্র খেতে বসলেন। চা টেস্ট মাখন ও দু’টি অর্ধ সিদ্ধ ডিম। আহারের সময় হরিশচন্দ্র কথা বলেন না‌, পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রাতরাশ শেষ করে মুখ মুছতে মুছতে বললেন‌, ‘রাজকুমারবাবুর খবর আর নিয়েছিলে?’

গুণধার বলল‌, ‘আম্ভেজ্ঞ‌, এবারও সাড়া পাওয়া গেল না।’

হরিশচন্দ্র ভ্রূকুটি করলেন। তারপর উঠে অফিস-ঘরে গেলেন। দেরাজ থেকে চাবির গোছা নিয়ে পকেটে ফেললেন‌, ‘চল‌, দেখি।’

ফাল্গুন মাস হলেও সাতটার সময় বেলা চড়েছে; কলতলায়‌, রান্নাঘরে‌, ডাইনিং রুমে বিষ্ণু-চাকরের কর্মতৎপরতা। আটটার সময় অতিথিদের ব্রেক-ফার্স্ট দিতে হবে।

সিঁড়িতে উঠতে উঠতে হরিশচন্দ্র পশ্চাদ্বতী গুণাধরকে জিজ্ঞেস করলেন‌, ‘কাল রাত্তিরে

গুণধর বলল‌, ‘আজ্ঞে‌, ছিলেন। রাত্রি পৌঁনে ন’টার সময় আমি নিজের হাতে তাঁকে ডিনার পৌছে দিয়েছি।’

‘রাত্তিরে সদর দরজা। কখন বন্ধ হয়েছিল?’

‘আপনি ফিরলেন এগারোটার সময়‌, তারপর আমি সদর বন্ধ করেছি।’

দোতলায় এক সারিতে আটটি ঘর‌, সামনে টানা বারান্দা। সিঁড়ির মুখেই ঘরের নম্বর আরম্ভ হয়েছে। সব দরজা ভেজানো। হরিশচন্দ্র দুনম্বর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে একটু কড়াভাবে টোকা দিলেন।

কেউ সাড়া দিল না। হরিশচন্দ্র তখন ডাক দিলেন‌, ‘রাজকুমারবাবু!’

এবারেও সাড়া এল না। হরিশচন্দ্র আরো গলা চড়িয়ে ডাকলেন‌, ‘রাজকুমারবাবু!’ তবু সাড়া নেই। হরিশচন্দ্র তখন দোরের হ্যান্ডেল ঘোরালেন‌, কিন্তু হ্যান্ডেল ঘুরল না। দোরে ইয়েল তালা লাগানো‌, চাবি না ঘোরালে বাইরে থেকে দোর খুলবে না।

হরিশচন্দ্র পকেট থেকে চাবির গোছা বার করলেন। এই সময় দুনম্বর ঘরের দুদিক থেকে দরজা খুলে দু’টি মুণ্ড উঁকি মোরল। এক নম্বর থেকে যিনি উঁকি মারলেন তিনি একটি বর্ষীয়সী। মহিলা। জিজ্ঞাসা করলেন‌, ‘কী হয়েছে?’ তিন নম্বর ঘর থেকে গলা বাড়িয়েছিলেন মধ্যবয়স্ক একটি পুরুষ; বললেন‌, ম্যানেজারবাৰু্‌্‌, আমার জ্বর হয়েছে শীগগির একজন ডাক্তার ডেকে পাঠান।

মহিলাটি বেরিয়ে এলেন‌, বললেন‌, ‘আমি ডাক্তার।’ তিনি হরিশ্চন্দ্বকে পেরিয়ে তিন নম্বর ঘরের সামনে গেলেন। তিন নম্বরের অধিবাসী শচীতোষ সান্যাল আরক্ত চক্ষু বিস্ফারিত করে একবার ডাক্তারের পানে তাকালেন‌, তারপর দরজা থেকে সরে গিয়ে বললেন‌, ‘আসুন।’

হরিশচন্দ্র গোছা থেকে চাবি বেছে নিয়ে তালায় পর্যালেন‌, দরজা একটু ফাঁক করে ভিতরে দেখলেন; কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন‌, তারপর দরজা টেনে আবার বন্ধ করে দিলেন।

বারান্দায় কেউ নেই। হরিশচন্দ্র এদিক ওদিক তাকিয়ে খাটো গলায় গুণধারকে বললেন‌, ‘গুণধর‌, তুমি এখানে থাকো‌, কোথাও যেও না। আমি এখনি আসছি।’ তাঁর কণ্ঠস্বর চাপা। উত্তেজনায় শীৎকারের মত শোনাল।

তিনি পা টিপে টিপে নীচে নেমে গেলেন। তিন নম্বর ঘরে মহিলা ডাক্তার শোভনা রায় রোগী শচীতোষ সান্যালকে বিছানায় শুইয়ে তাঁর টেম্পরেচার নিলেন‌, নাড়ি দেখলেন‌, জিভ পরীক্ষা করলেন। তারপর বললেন‌, ‘কিছু নয়‌, সামান ঠাণ্ডা লেগেছে। দুটো অ্যাসপিরিনের বড়ি খেয়ে শুয়ে থাকুন।’

শচীতোষ বললেন‌, ‘জ্বর কত?’

‘নাইনটি-নাইন।’

‘গায়ে যে ভীষণ ব্যথা।’

‘ও কিছু নয়। দো-রসার সময় হঠাৎ ঠাণ্ডা লেগে যায়। আমি অ্যাসপিরিনের বড়ি পাঠিয়ে ििछ!’

‘আপনার ফি কত?

‘ফি দিতে হবে না।’

তিন নম্বর থেকে বেরিয়ে শোভনা রায় দেখলেন‌, গুণধর দুনিম্বরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন‌, ‘এ ঘরে কী হয়েছে?’

0 Shares