রুম নম্বর দুই

গুণধর কেবল মাথা নাড়ল। শোভনা রায় আর কোনো প্রশ্ন না করে নিজের ঘরে প্রবেশ করলেন।

নীচে হরিশচন্দ্র তখন নিজের অফিস-ঘর থেকে পুলিসকে ফোন করছেন‌, ‘শীগগির আসুন‌, খুন হয়েছে–!’

গত রাত্রে ইন্সপেক্টর রাখাল সরকারের বাড়িতে সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের নেমন্তন্ন ছিল। সরকার মশায় দক্ষিণ কলকাতার একটি থানার অধিকারী থানাদার। ব্যোমকেশরা যখন কেয়াতলায় জমি কিনে বাড়ি তৈরি করতে আরম্ভ করেছিল তখন তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল; পরিচয় ক্রমে বন্ধুত্বে পরিণত হলো। সরকার মশায় পুলিস হলেও অত্যন্ত মিশুক এবং সহৃদয় বুড়ি বয়সে বোমকেশের চেয়ে কিছু ছোট‌, তাই বন্ধুত্বের সঙ্গে অনেকখানি সম্ভ্রম মেশানো ছিল।

ব্যোমকেশের সঙ্গে অজিতও এসেছিল নেমন্তন্ন খেতে। গল্পসল্প চলল। অনেক রাত পর্যন্ত। রাত বাড়ল কিন্তু গল্প শেষ হলো না। খাওয়া-দাওয়ার পর অজিত উঠি-উঠি করছে দেখে রাখালবাবু বললেন‌, ‘ব্যোমকেশদা‌, আপনি আজ রাতটা না হয় এখানেই থেকে যান। কাল সকালে একেবারে বড়ির কাজ তদারক করে বাসায় ফিরবেন।‘

ব্যোমকেশ বলল‌, ‘মন্দ কথা নয়। অজিত তুমি আজ ফিরে যাও‌, আমি কাল কাজকর্ম দেখে ফিরব।’

অজিত চলে গেল। কলকাতা শহরে এপাড়া থেকে ওপাড়া যাওয়া বিদেশ-যাত্রার সমান।

পরদিন সকাল পৌনে আটটার সময় ব্যোমকেশ চা-জলখাবার খেয়ে বেরুবার উপক্রম করছে। এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। রাখালবাবু ফোন ধরে কিছুক্ষণ নিবিষ্ট মনে শুনলেন : দুএকটা কথা বললেন‌, তারপর ফোন রেখে দিয়ে ব্যোমকেশকে বললেন‌, ‘থানা থেকে বলছিল। আমার এলাকায় একটা হোটেলে খুন হয়েছে। বেশ রহস্যময় ব্যাপার মনে হচ্ছে। আপনি যাবেন আমার সঙ্গে?’

ব্যোমকেশ বলল‌, ‘রহস্যময় খুন! নিশ্চয় যাব।’

ইন্সপেক্টর রাখাল সরকার ব্যোমকেশকে নিয়ে যখন নিরুপমা হোটেলে পৌঁছুলেন তখন থানা থেকে দু’জন সাব-ইন্সপেক্টর সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে এসে হোটেল দখল করেছে। সদর দরজায় একজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে। হোটেলের লোককে হোটেলে রাখা হয়েছে‌, বাইরের লোককে বাইরে।

রাখালবাবু্‌, হরিশচন্দ্রের অফিসে প্রবেশ করে দেখলেন‌, পুলিসের ডাক্তার কালো ব্যাগ নিয়ে অপেক্ষা করছেন। রাখালবাবু বললেন‌, ‘এই যে ডাক্তার এসে গেছেন দেখছি–আপনি হোটেলের ম্যানেজার?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘আপনিই লাশ আবিষ্কার করেছেন?’

‘হ্যাঁ।’

ইন্সপেক্টর সরকার এবং ব্যোমকেশ বক্সী পাশাপাশি চেয়ারে বসলেন‌, রাখালবাবু বললেন‌, ‘বেশ। আপনি কী জানেন সংক্ষেপে বলুন।’

আজ সকাল থেকে যা যা ঘটেছিল হরিশচন্দ্র বললেন। শুনে রাখালবাবু ব্যোমকেশের দিকে তাকালেন‌, ব্যোমকেশ একটু ঘাড় নাড়ল। রাখালবাবু তখন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন‌, ‘আপনি ঠিক কাজ করেছেন। চলুন ডাক্তার‌, এবার লাশ পরিদর্শন করা যাক।।’

হরিশচন্দ্র আগে আগে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় চললেন; তাঁর পিছনে রাখালবাবু্‌, ব্যোমকেশ ও ডাক্তার।

দোতলায় দুনম্বর ঘরের সামনে গুণধরের বদলে একজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে। হরিশচন্দ্র চাবি দিয়ে ঘর খুলে দিলেন। তখন ঘরের ভিতরটি দেখা গেল।

ঠিক দরজার সামনে মেঝের ওপর একটি পুরুষের মৃতদেহ ডানদিকে কত হয়ে পড়ে আছে; পরনে লুঙ্গি এবং গেঞ্জি। মুখখানা দেখে চমকে উঠতে হয়; কেউ যেন ধারালো ছুরি দিয়ে মুখখানাকে ফাল-ফালা করে কেটেছে‌, তারপর অত্যন্ত অযত্নভরে আবার জোড়া দিয়েছে। কাটা দাগগুলো তাজা নয়‌, অনেকদিনের পুরনো; শুকনো ক্ষতের দাগ মুখখানাকে কদাকার করে দিয়েছে।

মৃত্যুর কারণ কিন্তু অন্যত্র। গেঞ্জির বুকের ওপর খানিকটা রক্ত শুকিয়ে আছে।

দোরের কাছ থেকে কিছুক্ষণ মৃতদেহ পরিদর্শন করে রাখালবাবু বললেন‌, ‘ডাক্তার‌, আপনি আগে লাশ পরীক্ষা করুন। আপনার কাজ হয়ে গেলে আমরা ঘরে ঢুকব।’

ডাক্তার ঘরে প্রবেশ করলেন‌, বাকি তিনজন লাশের দিকে একদৃষ্টি তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ব্যোমকেশ একবার আড়চোখে হরিশচন্দ্রের মুখের পানে তাকালো, কিন্তু সেখানে ভয়ার্তি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না।

‘কী ব্যাপার বলুন দেখি? আমাকে এখনি বেরুতে হবে‌, কিন্তু পুলিস বেরুতে দিচ্ছে না। এর মানে কি?’ মহিলা কণ্ঠের উষ্ণ স্বর শুনে তিনজনে পিছু ফিরে তাকালেন। একটি মহিলা ক্রুদ্ধ ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছেন দেখে রাখালবাবু প্রশ্ন করলেন‌, ‘আপনি কে?’

হরিশচন্দ্র পরিচয় করিয়ে দিলেন‌, ‘ইনি এক নম্বর ঘরে থাকেন‌, ডক্টর মিসেস শোভনা রায়।’

রাখালবাবু মিনতির সুরে বললেন‌, ‘দেখুন‌, এই ঘরে কাল রাত্রে এক ভদ্রলোক খুন হয়েছেন। এ হোটেলে যাঁরা আছেন। সকলকেই আমাদের জেরা করতে হবে। জেরা করার আগে কাউকে বাইরে যেতে দিতে পারি না। কিন্তু আপনি নিশ্চিন্তু থাকুন‌, সকলের আগে আমি আপনাকে জেরা করে ছেড়ে দেব।’

মহিলাটির মুখের ভাব বদলে গেল‌, তিনি শঙ্কিত চক্ষে চেয়ে বললেন‌, ‘খুন হয়েছে! আমার পাশের ঘরে খুন হয়েছে। কখন? কে খুন করেছে?’

ইন্সপেক্টর মাথা নেড়ে বললেন‌, ‘তা এখনো জানা যায়নি। আপনি নিজের ঘরে গিয়ে বসুন‌, আমরা এখনি আসছি।’

মহিলাটি একটু ইতস্তত করলেন, একবার দুনম্বর ঘরের দিকে উঁকি মারলেন, তারপর নিজের ঘরে গিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিলেন।

ইতিমধ্যে সাব-ইন্সপেক্টর দু’জন উপস্থিত হয়েছিল‌, রাখালবাবু তাদের বললেন‌, ‘তোমরা একজন তেতলায় এবং একজন দোতলায় যত অতিথি আছেন। সকলের নাম-ধাম ঠিকানা নিয়ে নাও‌, কাল রাত্রে কে কোথায় ছিল খবর নাও। কেবল এক নম্বর আর তিন নম্বর ঘরে তোমাদের যাবার দরকার নেই‌, ওঁদের আমি জেরা করব।’

0 Shares