সাব-ইন্সপেক্টর দু’জন চলে গেল।
পাঁচ মিনিট পরে ডাক্তার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেন, ‘এবার লাশ সরাতে পারেন।’
রাখালবাবু বললেন, ‘কি দেখলেন?’
ডাক্তার উত্তর দিলেন, ‘ছুরির আঘাতে মৃত্যু হয়েছে; ছুরি কিংবা ওই রকম কোনো সরু ধারালো অস্ত্র। পাঁজরার ফাঁক দিয়ে একেবারে হৃদযন্ত্রে প্রবেশ করেছে। এ পেশাদার খুনীর কাজী : ওই একটি বই ক্ষতচিহ্ন নেই, প্রথম মারেই মর্মস্থানে পৌঁচেছে।’
‘হুঁ। মৃত্যুর সময়?’
‘অটপ্সি না করে নিশ্চয়ভাবে বলা শক্ত, সম্ভবত কাল রাত্ৰি নটা থেকে বারোটার মধ্যে।’
ব্যোমকেশ বলল, ‘মুখের দাগগুলো কতদিনের পুরনো?’
‘দশ বারো বছরের কম নয়।’ ‘বয়স কত হবে? মুখ দেখে তো বোঝা যায় না।’
‘চল্লিশের আশেপাশে–আচ্ছা, এখন আমি চলি। তাড়াতাড়ি লাশ পাঠিয়ে দেবেন, আজই কাটবো। কাল রিপোর্ট পাবেন।’ ডাক্তার চলে গেলেন।
রাখালবাবু হরিশচন্দ্রকে বললেন, ‘আপনি নিজের কাজে যান। অফিসেই থাকবেন। এ ঘরের চাবিটা আমায় দিন।’
আধঘণ্টা পরে লাশ চালান করে দিয়ে রাখালবাবু ব্যোমকেশের পানে তাকালেন। অর্থাৎ—অতঃ কিম?
ব্যোমকেশ এক নম্বর ঘরের দিকে আঙুল দেখালে, ‘মহিলাটির সওয়াল-জবাব আগে সেরে নিন। মহিলা এবং ডাক্তারের অধিকার আগে।’
‘ঠিক ঠিক। ওঁকে ছেড়ে দিয়ে তারপর এ ঘরটা দেখা যাবে।’ রাখালবাবু দুনম্বরের দোরে ঢাবি দিয়ে বললেন, ‘আসুন।’
এক নম্বরের দোরে টোকা দিতেই দোর খুলে গেল। মহিলাটির মুখ অপ্রসন্ন। তাঁর বেঁটে নিরেট গোছের শরীরটি আঁটসাঁট পোশাকের মধ্যে যেন অধীরতায় ফেটে পড়বার উপক্রম করছে। তিনি বললেন, ‘যত শীগগির পারেন আমাকে ছেড়ে দিন দারোগাবাবু। আমার কাজের ক্ষতি হচ্ছে।’
‘দুচারটে প্রশ্ন করেই আপনাকে ছেড়ে দেব।’ রাখালবাবু খাতা পেন্সিল বার করে প্রশ্ন আরম্ভ করলেন, ‘আপনার পুরো নাম?’
‘মিসেস শোভনা রায়।’
‘বয়স?’
‘উনপঞ্চাশ।’
‘স্বামীর নাম?’
‘স্বর্গীয় রামরতন রায়।’
‘আপনি ডাক্তার। কোথায় ডাক্তারি করেন?’
‘বহরমপুরে।’
‘কলকাতায় এসেছেন কেন?’
‘আমি গাইনকোলজিস্ট, প্রধানত স্ত্রী-রোগের চিকিৎসা করি। সেবা সদনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে, মাঝে মাঝে আসি।’
‘কলকাতায় আপনার আত্মীয়স্বজন কেউ নেই?’
‘আমার কোথাও কেউ নেই।’
‘ছেলে।পুলে?’
না। একটা মেয়ে ছিল, অনেকদিন মরে গেছে।’
মিসেস রায়ের মুখ ক্ষণেকের জন্য কঠিন হয়ে উঠল, তারপর আবার স্বাভাবিক হলো। মহিলাটির মুখখানি সুশ্ৰী নয়, কঠিন হলে আরো কুশ্রী দেখায়।
‘কলকাতায় যখন আসেন। এখানেই ওঠেন?’
‘হ্যাঁ। এখানে উঠলে সুবিধে হয়।’
‘এবার কবে এসেছেন?’
‘পরশু।‘
‘কাল রাত্রে পাশের ঘরে রাজকুমার বসু নামে এক ভদ্রলোক খুন হয়েছেন। তাঁকে আপনি চিনতেন?’
‘না, কখনো নাম শুনিনি।’
‘আগে কখনো দেখেননি? পাশাপাশি ঘরে ছিলেন। তাই জিজ্ঞাসা করছি।’
‘না। ও মুখ দেখলে মনে থাকত।’
‘কাল রাত্রি আটটার পর আপনি কোথায় ছিলেন?’
‘আটটার সময় আমি সেবা সদন থেকে ফিরে আসি।। ঘরে এসে হাত-মুখ ধুয়ে কাপড়-চোপড় বদলে নীচে ডাইনিং রুমে খেতে গেলুম। ন’টার আগেই ঘরে ফিরে এলুম। তারপর আর ঘর থেকে বেরোইনি।’
‘রাত্রে কিছু জানতে পেরেছিলেন?’
‘আমি সওয়া ন’টার সময় শুয়ে পড়েছিলুম; কিন্তু বার বার ঘুমের বিঘ্ন হচ্ছিল। পাশের ঘরের শব্দে চটকা ভেঙে যাচ্ছিল।’
‘পাশের ঘরে শব্দ হচ্ছিল?’
‘ঘরে শব্দ হচ্ছিল। কিনা শুনতে পাইনি। কিন্তু ঘরের দরজা বার বার খুলছিল। আর বন্ধ হচ্ছিল।’
‘রাত্রি তখন কত?’
‘ঘড়ি দেখিনি। আন্দাজ সাড়ে ন’টা থেকে দশটার মধ্যে।’
‘আপনি কিছু করলেন?’
‘কী করব! হোটেলে অনেক অবিবেচক লোক আসে, তারা পরের সুবিধা অসুবিধা বোঝে না।’
‘আজ সকলে কখন জানতে পারলেন?’
‘খুন হয়েছে আপনার কাছে জানলাম। ভোরবেলা চাকর বেড়-টি দিয়ে গেল। তারপর আমি তৈরি হয়ে বেরুতে যাচ্ছি, নীচে ব্রেক-ফার্স্ট খেয়ে কাজে যাব, এমন সময় পাশের ঘরে দোর-ঠেলাঠেলি চেঁচামেচি শুনতে পেলুম। বেরিয়ে দেখলুম ম্যানেজার; জিজ্ঞেস করলুম কী হয়েছে, সে কিছু বলল না। তারপর তিন নম্বর ঘরে গেলাম—’
‘তিন নম্বর ঘরে গেলেন কেন?’
‘তিন নম্বরের ভদ্রলোকটির শরীর খারাপ হয়েছে, ডাক্তার খুঁজছিলেন। তাই তাঁকে দেখতে গিয়েছিলুম।’
‘তাকে আগে থাকতে চিনতেন বুঝি?
‘দেখেছি। কিন্তু চেনা-পরিচয় কিছু ছিল না। তাঁর নামও জানি না।
‘ও-কি হয়েছে ভদ্রলোকের?’
‘ঠাণ্ডা লেগে সামান্য জ্বর হয়েছে।’
রাখালবাবু ব্যোমকেশের পানে তাকালেন, ব্যোমকেশ মাথা নেড়ে জানাল আর কোনো প্রশ্ন নেই। রাখালবাবু শোভনা রায়কে বললেন, ‘আপাতত আর কোনো প্রশ্ন নেই, আপনি কাজে যেতে পারেন। কিন্তু আমাদের না জানিয়ে কলকাতা ছাড়বেন না।’
শোভনা রায়ের মুখ বিরক্ত হয়ে উঠল। তিনি উত্তর না দিয়ে ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়ালেন।
দুনম্বর ঘরের দরজা খুলতে খুলতে রাখালবাবু বললেন, ‘মহিলাটির মেজাজ একটু কড়া। ভয় পাননি; বোধহয় পুলিসের কার্যকলাপের সঙ্গে পরিচয় আছে। ডাক্তার তো।—যাহোক, আসুন দেখা যাক ঘরের মধ্যে আততায়ী কোনো চিহ্ন রেখে গেছে। কিনা।–কনস্টেবল হাজরা, তুমি নীচে গিয়ে হেড-অফিসে ফোন করে–যেন ফিঙ্গারপ্ৰিণ্ট এক্সপার্টদের পাঠানো হয়।’ কেলেস্টরল সালুট করে চলে গেল। য়াখালবাবু ব্যোমকেশকে নিয়ে ঘরে ঢুকে দোর ভেজিয়ে
ঘরটি আয়তনে দশ ফুট বাই বারো ফুট। একটি একহারা লোহার খািট; ছোট টেবিল এবং চেয়ার, দেয়ালে আয়না লাগানো। তার পাশে কাপড় রাখার আলনা; মাথার ওপর ফ্যান। দু’জনে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চারিদিকে দৃষ্টি ফেরালেন।