রুম নম্বর দুই

রাখালবাবু বললেন‌, ‘বিছানাটা দেখেছেন?’

‘দেখেছি। বিছানা এবং আলনা— দুইই দ্রষ্টব্য।’

বিছানা দেখে মনে হয় কাল রাত্রে রাজকুমার বসু বিছানায় শুয়েছিল; চাদর একটু কুঁচকে আছে‌, বালিশের ওপর মাথার দাগ। আলনায় একটি কোঁচানো ধুতি ও পাঞ্জাবি টাঙানো রয়েছে।

রাখালবাবু বললেন‌, ‘হুঁ। কি মনে হচ্ছে?’

‘মনে হচ্ছে কাল রাত্রে রাজকুমার বসু কাপড় পাঞ্জাবি ছেড়ে লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে শুয়েছিল। তারপর একসময় দোরে টোকা পড়ল। রাজকুমার বিছানা থেকে উঠে যেই দোর খুলল আততায়ী অমনি বাইরে থেকে তার বুকে ছুরি মারল। রাজকুমার পড়ে গেল। আর উঠল না। আততায়ী দরজা টেনে বন্ধ করে চলে গেল। আমার বিশ্বাস আততায়ী ঘরে ঢোকেনি‌, ফিঙ্গারপ্ৰিণ্ট এক্সপার্ট রাজকুমার ছাড়া আর কারুর আঙুলের ছাপা ঘরের মধ্যে পাবে না। দোরের হাতলে আততায়ীর আঙুলের ছাপা হয়তো ছিল‌, কিন্তু এখন আর পাওয়া যাবে না। তার ওপর আরো অনেক আঙুলের ছাপা পড়েছে।’

রাখালবাবু বললেন‌, ‘তা বটে। তবু অধিকন্তু ন দোষায়। আসুন‌, ঘরটা তল্লাশ করে দেখা यांक।?

ব্যোমকেশ বলল‌, ‘আপনি তল্লাশ করুন। আমি কোনো জিনিসে হাত দেব না‌, তাতে আঙুলের ছাপ বেড়ে যাবে।’

‘বেশ‌, আপনি তাহলে দাঁড়িয়ে তদারক করুন।’

রাখালবাবু বিধিবদ্ধভাবে তল্লাশ আরম্ভ করলেন। টেবিলের দেরাজ‌, পাঞ্জাবির পকেট‌, বিছানার তেশকের নীচে‌, সর্বত্র অনুসন্ধান করলেন। কিন্তু কিছু পেলেন না। অবশেষে খাটের তলা শুধু একটা সুটকেস টেন বার করলেন। মৃতের এই একটিমাত্র মাল ধরে আছে‌, আর কিছু নেই।

সুটকেসের গায়ে চাবি লাগানো ছিল‌, রাখালবাবু ডালা তুললেন। দেখা গেল‌, দু’ সেট জামাকাপড় রয়েছে। কাপড়ের নীচে এক গোছা দশ টাকার নোট‌, আর একটি ডায়েরির আকারের ছোট বাঁধানো খাতা।

খাতাটি সরিয়ে রেখে রাখালবাবু প্রথমে দশ টাকার নোটগুলি শুনলেন; একশো কুড়িখানা নোট‌, অর্থাৎ ঠিক ১২০০ টাকা। তিনি নোটগুলি নিজের পকেটে রাখতে রাখতে বললেন‌, ‘দেখা যাচ্ছে‌, যে খুন করেছে তার টাকার লোভ নেই।’ তিনি খাতাটি তুলে নিলেন।

খাতার নাম পৃষ্ঠায় নাম লেখা রয়েছে–সুকান্ত সোম। রাখালবাবু ব্যোমকেশের পানে তাকালেন। ব্যোমকেশ বলল‌, ‘রাজকুমার নামটা তাহলে মেকি। কিন্তু–সুকান্ত সোম! যেন কোথায় শুনেছি‌, মাথার মধ্যে একটা ঘন্টি বাজছে। আপনি শোনেননি?’

‘মনে পড়ছে না।’ রাখালবাবু খাতার পাতা ওলটাতে লাগলেন। প্রত্যেক পাতার মাথায় একটি শহরের নাম‌, যেমন–কাশী কলকাতা কটক। শহরের নীচে কয়েকটি নাম ও ঠিকানা‌, সম্ভবস্থলে টেলিফোন নম্বর। কলকাতার পাতায় চারটি নাম লেখা আছে‌, প্রায় প্রত্যেক নামের পাশে একটি টাকার অঙ্ক। যথা—

মোহনলাল কুণ্ডু

১১৭ডি‌, পানাপুকুর লেন

শ্যামাকান্ত লাহিড়ী ৫০০্‌

৩০/১‌, লোক কলোনী

জগবন্ধু পাত্র ৪০০্‌

৫৬‌, রাম ভাদুড়ী লেন

লতিকা চৌধুরী ৩০০্‌

১৭‌, গান্ধী পার্ক

খাতাখানা ব্যোমকেশের হাতে দিয়ে রাখালবাবু বললেন‌, ‘দেখুন যদি কিছু হদিস পান।’

ব্যোমকেশ খাতাখানা মন দিয়ে পরীক্ষা করে বলল‌, ‘আমার সন্দেহ হচ্ছে লোকটার পেশা ছিল ব্ল্যাকমেল করা।’

‘অন্য পেশা কি সম্ভব নয়? যেমন ধরুন‌, বীমার দালাল।’

‘অসম্ভব বলছি না। কিন্তু বীমার দালালকে কেউ খুন করে না। তারা ছদ্মনামেও ঘুরে বেড়ায় না।’

‘তাহলে আপনি মনে করেন‌, রাজকুমার বসু যাদের ব্ল্যাকমেলা করছিল তাদের মধ্যে কেউ তাকে খুন করেছে?’

‘কলকাতার ফিরিস্তিতে যাদের নাম আছে তাদের সওয়াল করলে কতকটা আন্দাজ করা যাবে।–চলুন‌, এবার তিন নম্বর মক্কেলের সঙ্গে দেখা করা যাক।’

‘চলুন।’

তিন নম্বর ঘরে শচীতোষ সান্যাল বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে ছিলেন‌, পদশব্দ শুনে ঘাড় তুললেন। বললেন‌, ‘কে?’

রাখালবাবু সংক্ষেপে বললেন‌, ‘পুলিস।’

শচীতোষবাবু উঠে বসলেন‌, চক্ষু গোল করে বললেন‌, ‘পুলিস! কী চাই?’

রাখালবাবু বললেন‌, ‘আপনাকে দুচারটে প্রশ্ন করতে চাই। জানেন বোধহয় পাশের দুনিম্বর ঘরে খুন হয়েছে।’

শচীতোষবাবু মুহুর্তকাল নির্বাক থেকে আঁৎকে উঠলেন‌, ‘খুন হয়েছে! কে খুন হয়েছে?’

তিন নম্বর ঘরটি আয়তনে এবং আসবাবপত্রে অন্য দু’টি ঘরের অনুরূপ। রাখালবাবু বিছানার ধারে বসলেন। ব্যোমকেশ চেয়ারে বসল। রাখালবাবু বললেন‌, ‘দু নম্বরে যিনি ছিলেন কাল রাত্রে তিনি খুন হয়েছেন‌, তাঁর নাম রাজকুমার বসু। আপনি তাঁকে চিনতেন নাকি?’

‘রাজকুমার বোস-না‌, চিনতাম না। কে খুন করেছে?’

‘তা এখন জানা যায়নি। আপনার নাম কি?’

‘শচীতোষ সান্যাল।’

‘নিবাস?’

‘ভাগলপুর। — আমার শরীর খারাপ‌, ডাক্তার শুয়ে থাকতে বলেছে।’

‘কোন ডাক্তার?’

‘মেয়ে ডাক্তার। ঠাণ্ডা লেগেছে‌, অ্যাসপিরিনের বড়ি খেয়ে শুয়ে থাকতে বলল। আচ্ছা‌, মেয়েরা কি ভাল ডাক্তার হয়?’

‘হাতে বাধা নেই। ঠাণ্ডা লাগালেন কি করে?

‘কাল সন্ধ্যের পর বেরিয়েছিলাম। গায়ে আলোয়ান ছিল না‌, ঠাণ্ডা লেগে গেছে।’

‘রাত্তিরে ঘর থেকে বেরোননি?’

‘না। ন’টার সময় ডাইনিং রুম থেকে খেয়ে এসে ঘরে ঢুকেছিলাম‌, আর বেরোইনি।’

‘ও কথা থাক। আপনি কবে কলকাতায় এসেছেন?’

‘তিন দিন হলো। আজ ফিরে যাবার কথা‌, কিন্তু

‘আপনি কলকাতায় এসেছেন কেন?’

‘আমার ঘিয়ের ব্যবসা আছে‌, গাঙ্গুরামকে ঘি যোগান দিই। তাই মাঝে মাঝে আসতে হয়। আচ্ছা‌, ঠাণ্ডা লাগা থেকে তো নিউমোনিয়া হতে পারে।’

‘তা পারে‌, কিন্তু আপনার হবে না। আপনি বেশ তাগড়া আছেন।–বয়স কত?’

‘বিয়াল্লিশ। দেখতে তাগড়া বটে‌, কিন্তু আমার শরীর ভারি পলকা‌, একটুতেই রোগে ধরে। বেজায় ক্ষিদে পেয়েছে; কিছু খেলে রোগ বেড়ে যাবে না তো?’

0 Shares