‘গরম দুধ আর পাউরুটি খান। — রাজকুমার বোসকে তাহলে চিনতেন না?’
‘না, কখনো নাম শুনিনি।’
ব্যোমকেশ বলল, ‘সুকান্ত নামটা কখনো শুনেছেন?’
শচীতোষ বললেন, ‘সুকান্ত? না। আমার শালার নাম ছিল শ্ৰীকান্তকুমার লাহিড়ী, মারা গেছে।’
রাখালবাবু প্রশ্ন করলেন, ‘কাল রাত্রে আপনি পাশের ঘরে কোনো শব্দ শুনেছিলেন?’
‘শব্দ? নাঃ। খেয়ে এসেই শুয়েছি, শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছি। বউ বলে, আমি একবার ঘুমেলে ডাকাত পড়লেও ঘুম ভঙে না। পাশের ঘরের লোকটাকে কী দিয়ে খুন করেছে? বন্দুক দিয়ে?’
‘না, ছুরি দিয়ে।’ রাখালবাবু উঠে পড়লেন, ‘আপনি পুলিসকে খবর না দিয়ে কলকাতা ছেড়ে যাবেন না। চলুন ব্যোমকেশদা।’
নীচে অফিস-ঘরে হরিশচন্দ্র জবুথবুভাবে বসেছিলেন, ব্যোমকেশদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন, কুষ্ঠিত প্রশ্ন করলেন, ‘কী হলো?’
রাখালবাবু প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘এবার আপনাদের, অর্থাৎ হোটেলের স্টাফের এজেহার নেব। আপনাকে দিয়েই আরম্ভ করি। বসুন।’
তিনজনে বসলেন। রাখালবাবু সওয়াল-জবাব আরম্ভ করলেন, ‘আপনার পুরো নাম?’
‘হরিশচন্দ্র হোড়।’
‘আপনি হোটেলের ম্যানেজার। এখানেই থাকেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘কতদিন আছেন?
‘আট বছর।’
‘মৃত রাজকুমার বোস সম্বন্ধে কী জানেন বলুন।’
হরিশচন্দ্র মোটা খাতা বার করে খুললেন, ‘রাজকুমার বসু্্, ঠিকানা আদমপুর, পাটনা। গত পাঁচ বছর ধরে তিনি বছরে দু’বার এখানে আসতেন, দু’ তিনদিন থাকতেন। হোটেল থেকে বেরুতেন না, এই অফিসে এসে তিন-চারজন বন্ধুকে টেলিফোন করতেন। তাঁরা এসে সন্ধ্যের পর তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন। এর বেশি আমি কিছু জানি না।’
‘এবার তিনি কবে এসেছিলেন?’
‘পরশু।‘
‘টেলিফোন করেছিলেন?’
‘পরশু রাত্রে এলেন, সে-রাত্রে টেলিফোন করেননি। কাল সকালে করেছিলেন।’
‘রাজকুমারবাবু যখন আসতেন ওই দু’ নম্বর ঘরেই থাকতেন?’
না, যখন যে-ঘর খালি থাকত সেই ঘরে থাকতেন।’
‘রাজকুমারবাবুকি কাজ করতেন। আপনি জানেন?
‘আজ্ঞে না।’
‘আপনি কাল রাত্ৰে নিশ্চয় হোটেলেই ছিলেন?’
‘আজ্ঞে–’। হরিশচন্দ্র একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘ঘণ্টা দুয়ের জন্যে একবার বেরিয়েছিলাম। আমি হোটেলে থাকি বটে, কিন্তু আমার পরিবার বাইরে ভাড়া বাড়িতে থাকে; মাঝে মাঝে তাদের দেখতে যাই। কাল রাত্রে অতিথিরা খেতে বসবার পর আমি বেরিয়েছিলাম, তারপর এগারোটা নাগাদ ফিরে আসি।’
‘আপনার অবর্তমানে হোটেলের ইন-চার্জ থাকে কে?’
‘সদার খানসামা গুণধর গুঁই।’
‘গুণধরকে একবার ডাকুন।’
গুণধরকে ডাকা হলো, সে এসে দাঁড়াল। আবার প্রশ্নোত্তর আরম্ভ হলো।
‘রাজকুমার বোস–যিনি খুন হয়েছেন–তাঁর সম্বন্ধে তুমি কী জান?’
‘আজ্ঞে, বেশি কিছু জানি না। তিনি মাঝে মাঝে আসতেন, দু’ তিনদিন থেকে চলে যেতেন।’
‘তোমার সঙ্গে তাঁর কোনো কথাবার্তা হতো না?’
‘আজ্ঞে, খুব কম। ফাই-ফরমাস করতেন, তার বেশি নয়।’
‘তাঁর দেখাশোনা করত কে?’
‘আজ্ঞে, আমি করতাম। সকালে বেড়-টি নিয়ে যেতাম, তারপর ব্রেকফার্স্ট লাঞ্চ ডিনার সব আমিই পৌঁছে দিতাম। দোতলায় যাঁরা থাকেন আমিই তাঁদের দেখাশোনা করি। তেতিলায় দেখাশোনা করে–’
‘ও—তাহলে রাজকুমারবাবু ডাইনিং রুমে খেতে নামতেন না।’
‘আজ্ঞে না।‘
‘কাল তুমি তাঁকে শেষবার কখন দেখেছ?’
‘রাত্রি পৌঁনে ন’টার সময় তাঁকে ডিনার দিতে গেছলাম, তারপর নাটার সময় এটো বাসন-কোসন আনতে গেছলাম। তখন তিনি বেঁচে ছিলেন।’
‘বুঝলাম। কিন্তু তিনি ডাইনিং রুমে যেতেন না কেন বলতে পার?’
‘তা-জানি না হুজুর। তবে— বোধহয়–তাঁর মুখখানা কাটাকুটি হয়ে বড় ইয়ে হয়ে গিয়েছিল-তাই তিনি সহজে লোকের সামনে বেরুতেন না।’
‘তা হতে পারে। কিন্তু তাঁর কাছে লোক আসত?’
‘তা আসত হুজুর।’
‘কাল কে কে এসেছিল তুমি জান?
‘আমি জানি না, জেনারেল সিং বলতে পারে।’
‘জেনারেল সিং।’
‘আজ্ঞে, আমাদের দারোয়ান। তার নাম রামপিরিত সিং, সবাই তাকে জেনারেল সিং বলে ডাকে।‘
‘ডাকো জেনারেল সিংকে।’
ভোজপুরী জোয়ান রামপিরিত সিং এসে গোড়ালিতে গোড়ালি ঠেকিয়ে স্যালুট করল। আখাম্বা চেহারা, জাঁদরেল পোশাক, ইয়া গোঁফ। রাখালবাবু তার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বললেন, ‘হ্যাঁ, জেনারেল বটে। তুমি হোটেলের সদরে পাহারা দাও?’
রামপিরিত বলল, ‘জি। সকালে নটা থেকে বারোটা, বিকেলে পাঁচটা থেকে দশটা আমার ডিউটি।‘
‘হোটেলে যারা অতিথিদের সঙ্গে দেখা করতে আসে তাদের নাম-ধাম তুমি লিখে রাখ?’
‘জি না, সে-রকম হুকুম নেই। যারা ভাল সাজ-পোশাক পরে আসে তাদের স্যালুট করি, যারা অতিথির রুম নম্বর জানতে চায় তাদের রুম নম্বর বলি।’
‘কাউকে আটকাও না?’
‘জি, ভাল জামা-কাপড় পরা থাকলে আটকাই না।’
‘আর যদি ছেঁড়া জাম-কাপড় হয়?’
‘তখন কটমট করে তাকাই।’
‘শাবাশ। এবার বল দেখি, কাল সন্ধ্যের পর দোতলার দু’ নম্বর ঘরের বাবুর সঙ্গে কেউ দেখা করতে এসেছিল?’
‘জি, এসেছিল। দু’জন মরদ আর একজন ঔরৎ। রাত্রি সওয়া ন’টার সময় এলেন ঔরৎ, তিনি ঘরের নম্বর জেনে নিয়ে দোতলায় গেলেন; পাঁচ মিনিট পরে তিনি চলে গেলেন।’
‘তাঁর বয়স কত?
‘বিশ-পঁচিশ হবে হুজুর। গোরী, পাতলা লম্বা চেহারা, চোখে চশমা ছিল।’
‘বেশ। তারপর?’
‘তারপর সাড়ে ন’টার সময় এলেন এক মরদ। তিনি ঘরের নম্বর নিয়ে ওপরে গেলেন, পাঁচ মিনিট পরে ফিরে চলে গেলেন। এর চেহারা দুবলা, মুছ-দাড়ি আছে। থোড়া থোড়া।’
‘তারপর?’
‘পৌঁনে দশটার সময় আর একজন মরদ এলেন। মোটা-তাজা শরীর, খাঁটি বাঙ্গালী বাবু। তিনিও ওপরে গিয়ে পাঁচ মিনিট ছিলেন। তারপর আমার ডিউটির মধ্যে আর কেউ আসেনি হুজুর।’