রুম নম্বর দুই

জেনারেল রামপিরত সিং-এর চেহারা যত স্থূলই হোক‌, স্মৃতিশক্তি যে খুব তীক্ষ্ণ তাতে সন্দেহ নেই। রাখালবাবু খুশি হয়ে বললেন‌, ‘বহুৎ আচ্ছা। তুমি এখন আরাম কর গিয়ে।’

জেনারেল জোড়া পায়ে স্যালুট করে চলে গেল।

রাখালবাবু পকেট থেকে ১২০০ টাকার নোট বার করে হরিশচন্দ্রের হাতে দিলেন‌, বললেন‌, ‘আপাতত এ টাকাটা আপনার কাছে রাখুন‌, মৃতের সুটকেসে পাওয়া গেছে। টাকার জন্যে একটা  রসিদ দিন।‘

ঘরে একটি লোহার সিন্দুক ছিল‌, হরিশচন্দ্র নোটগুলি সিন্দুকে রেখে রসিদ লিখে দিলেন। ব্যোমকেশ ভুরু কুঁচকে বসে রইল।

ইতিমধ্যে সাব-ইন্সপেক্টর দু’জন নেমে এসে দাঁড়িয়েছিল‌, রাখালবাবু তাদের প্রশ্ন করলেন‌, ‘কি হলো?’

একটি সাব-ইন্সপেক্টর বলল‌, ‘আমি তেতলায় গিয়েছিলাম। সকলের নাম-ধাম লিখে দুয়েছি‌, সকলেই বলল‌, ন’টার পর ভিলার খেয়ে তার ঘরে ফিরে এসেছিল‌, আর ঘর থেকে বেরোয়নি।’

‘তাদের কথা সত্যি কিনা যাচাই করেছিলে?’

‘কি করে যাচাই করব? প্রত্যেকের আলাদা ঘর। তবে একটা প্রমাণ আছে‌, রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পালা শেষ হলে একটা চাকর তেতলার সিড়ির সামনে শোয়; তাকে ডিঙিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামা সম্ভব নয়। আমি চাকরিটাকে জিজ্ঞেস করেছি‌, সে বলল‌, রাত্রি সাড়ে দশটার সময় সে শুতে গিয়েছিল‌, তারপর আর কেউ সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামেনি।’

‘বেশ। —আর তুমি?’

দ্বিতীয় সাব-ইন্সপেক্টর বলল‌, ‘দোতলাতেও একই অবস্থা। সকলের নাম-ঠিকানা লিখে নিয়েছি। দোতলার সিঁড়ির মুখে যো-চাকরটা শোয় সে বলল‌, পৌঁনে এগারোটার সময় সে শুতে গিয়েছিল‌, তারপর আর কেউ ঘর থেকে বেরোয়নি।’

ম্যানেজার বললেন‌, ‘রাত্রে যদি কোনো অতিথির কিছু দরকার হয়‌, তাই এই ব্যবস্থা।’

‘বুঝলাম।’–রাখালবাবু ঘড়ি দেখলেন‌, বারোটা বেজে গেছে। তিনি ব্যোমকেশকে বললেন‌, ‘এখানকার কোজ আপাতত এই পর্যন্ত। চলুন এবার বেরিয়ে পড়া যাক‌, রাস্তায় কোথাও খেয়ে নেওয়া যাবে। ভাগ্যক্রমে চারজন মক্কেলের বাড়ি কাছাকাছির মধ্যেই‌, বেশি ঘোরাঘুরি করতে হবে না। আপনার বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেল–’

ব্যোমকেশ বলল‌, ‘কোনো ক্ষতি নেই‌, আমি অজিতকে টেলিফোন করে দিচ্ছি।’

সে টেলিফোন তুলে নিল। হরিশচন্দ্র বললেন‌, ‘যদি আপত্তি না থাকে এখানেই আপনাদের সকলের আহারের ব্যবস্থা করেছি।’

রাখালবাবু হেসে বললেন‌, ‘খুব ভাল কথা।’

নিরুপমা হোটেলের রান্না ভাল।

মধ্যাহ্ন ভোজন দেশী ও বিলাতি মতে সমাধা করে পুলিসের দল ডাইনিং রুম থেকে বেরুলেন‌, সঙ্গে ব্যোমকেশ। রাখালবাবু দ্বিতীয় সাব-ইন্সপেক্টরকে বললেন‌, ‘দত্ত‌, তুমি এখানে থাকে। এই নাও‌, দু’ নম্বর ঘরের চাবি। ফিঙ্গারপ্রিন্টের দল এখনি আসবে‌, তাদের ঘর খুলে দিও। আমি ঘোষকে নিয়ে বেরুচ্ছি। আসুন ব্যোমকেশদা।’

তিনজনে ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়ালেন। রাখালবাবু পকেট থেকে খাতা বার করে বললেন‌, ‘এ সময় কাউকে বাড়িতে পাব। কিনা বলা যায় না। যাহোক‌, চলুন আগে জগবন্ধু পাত্রকে দেখা যাক! লোকটিকে ওড্র-কুলোদ্ভব মনে হচ্ছে।’

ব্যোমকেশ বলল‌, ‘হুঁ।’

একটা ট্যাক্সি ধরে তিনজনে উঠে বসলেন‌, ট্যাক্সি জগবন্ধু পাত্রের ঠিকানা লক্ষ্য করে ছুটিল। রাখালবাবু বললেন‌, ‘ব্যোমকেশদা‌, আজ আপনি এমন চুপচাপ কেন? কিছু বলছেন না।’

ব্যোমকেশ বলল‌, ‘এখন কেবল শুনে যাচ্ছি‌, বলা-কওয়ার সময় এখনো আসেনি।–সময় যেদিন আসিবে আপনি যাইব তোমার কুঞ্জে।’

জগবন্ধু থাকেন একটি তেতলা বাড়ির নীচের ফ্ল্যাটে। রাখালবাবু কড়া নাড়লেন‌, একটি লোক দোর খুলে দাঁড়াল। ছাঁটা দাড়ি‌, কোল-কুঁজো ধরনের চেহারা‌, বয়স আন্দাজ চল্লিশ। রাখালবাবু বললেন‌, ‘আপনার নাম জগবন্ধু পাত্র?

‘হাঁ।’ জগবন্ধু পুলিসের ইউনিফর্ম দেখে একটু সচকিত হয়ে বললেন‌, ‘কি দরকার?’

‘নিরুপমা হোটেলে রাজকুমার বসু নামে এক ব্যক্তি খুন হয়েছেন—‘

‘জগবন্ধু পাত্রের মুখে অকৃত্রিম বিস্ময় ফুটে উঠল‌, তিনি বলে উঠলেন‌, ‘রাজকুমার খুন হয়েছে!’ ‘হ্যাঁ। আপনাকে দু’ একটা প্রশ্ন করতে চাই।’

‘আসুন।’ জগবন্ধু পাত্র একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে তাঁদের বসলেন‌, ‘বসুন‌, আমি এখনি আসছি।’

তিনি পাশের ঘরে চলে গেলেন।

বসবার ঘরটি ছোট এবং নিরাভরণ; একটি টেবিল ও তিনটি চেয়ার আছে; টেবিলের ওপর টেলিফোন। ব্যোমকেশ সিগারেট ধরিয়ে ঘরের এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল‌, কিন্তু কোথাও গৃহস্বামীর চরিত্রের কোনো পরিচয় পেল না।

পাঁচ মিনিট কাটল‌, দশ মিনিট কাটল‌, জগবন্ধু পাত্রের দেখা নেই। রাখালবাবু তখন গলা চড়িয়ে ডাকলেন‌, ‘জগবন্ধুবাবু!’ কিন্তু উত্তর এল না।

ব্যোমকেশ মুখ টিপে হাসল‌, বলল‌, ‘মনে হচ্ছে জগবন্ধু পাত্র গৃহত্যাগ করেছেন।’

রাখালবাবু উত্তেজিত হয়ে বললেন‌, ‘পালিয়েছে! এসো ঘোষ‌, বাড়ির ভেতরটা দেখা যাক। আসুন ব্যোমকেশদা।’

ব্যোমকেশ কিন্তু গেল না; ঘোষকে নিয়ে রাখালবাবু ভিতরে গেলেন। দেখলেন‌, কেউ নেই‌, খিড়কির দোর খোলা।

রাখালবাবু ফিরে এসে বললেন‌, ‘পাখি উড়েছে।’

ব্যোমকেশ ইতিমধ্যে টেবিলের দেরাজ খুলে একটা বাঁধানো খাতা বার করেছিল‌, তার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলল‌, ‘লোকটা বোধহয় ঘোড়দৌড়ের টাউট ছিল।’

‘তাই নাকি! কিন্তু পালাল কেন?’

‘নিশ্চয় গুরুতর গলদ আছে। শুধু ঘোড়দৌড় হলে পালাত না।’

রাখালবাবু থানায় ফোন করলেন। পলাতকের বর্ণনা দিলেন‌, আরো লোক ডেকে পাঠালেন। তারপর ফোন নামিয়ে বললেন‌, ‘ঘোষ‌, তুমি এখানে থাকে‌, আমরা অন্য কাজে যাচ্ছি। এখনি থানা থেকে আরো লোক এসে পড়বে। বাড়ি তন্ন তন্ন করে তল্লাশ করো। আঙুলের ছাপ নিশ্চয় পাবে; ততক্ষণাৎ হেডু অফিসে পাঠিয়ে দেবে। লোকটা বোধহয় দাগী আসামী।’

0 Shares