জগবন্ধু পাত্রের বাসা থেকে বেরিয়ে রাখালবাবু ব্যোমকেশকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি মনে হয়? জগবন্ধু পাত্রই আমাদের আসামী?
ব্যোমকেশ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘বলা যায় না। লোকটা রাজকুমারের মৃত্যু-সংবাদ শুনে চমকে উঠেছিল। তবে অভিনয় হতে পারে।’
অতঃপর মোহনলাল কুণ্ডুর বাসায় গিয়ে জানা গেল, কুণ্ডু মশাই কলকাতায় নেই। সস্ত্রীক কাশী গিয়েছেন। কবে ফিরবেন ঠিক নেই।
সেখান থেকে তাঁরা শ্যামাকান্ত লাহিড়ীর বাড়ি গেলেন। কিন্তু এখানেও নিরাশ হতে হলো। শ্যামাকান্ত বাড়ি নেই, অফিসে গেছেন। শ্যামাকান্ত পোর্ট কমিশনারের অফিসে বড় চাকরি করেন। এইটুকুই শুধু জানা গেল। সন্ধ্যের আগে তাঁকে পাওয়া যাবে না।
রাখালবাবু নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘বাকি রইলেন শুধু লতিকা চৌধুরী। ইনি যখন মহিলা তখন আশা করা যায় দুপুরবেলা এঁকে বাসায় পাওয়া যাবে।’
শ্ৰীমতী চৌধুরী স্বতন্ত্র বাড়িতে থাকেন, ফ্ল্যাট নয়। ছোটখাটো বাড়িটি, বেশ পরিচ্ছন্ন, সামনে একফালি ফুলের বাগান। ঘণ্টি বাজাতেই একটি চশমা-পরা মহিলা দোর খুলে বললেন, ‘কাকে চাই? কর্তা বাড়ি নেই।’ তারপরই তাঁর চকিত দৃষ্টি পড়ল রাখালবাবুর ইউনিফর্মের ওপর।
জেনারেল রামপিরিত যে বৰ্ণনা দিয়েছিল, মহিলাটির সঙ্গে তার মিল আছে। তবে বয়স বিশ-পঁচিশ নয়, আরো বেশি। ত্রিশ-বত্ৰিশ বছর বয়সেও কিন্তু ছিমছাম গড়ন এবং সুশ্ৰী মুখ থেকে যৌবনের রেশ সম্পূর্ণ মুছে যায়নি।
রাখালবাবু বললেন, ‘আপনার নাম শ্ৰীমতী লতিকা চৌধুরী?’
শ্ৰীমতী চৌধুরীর ঠোঁট হঠাৎ আলগা হয়ে গেল, তিনি স্খলিতস্বরে বললেন, ‘হ্যাঁ। কি দরকার?’
রাখালবাবু বললেন, ‘আপনাকে দু-চারটে প্রশ্ন করতে চাই। আমি পুলিসের লোক।’
শঙ্কা-শীর্ণ মুখে মিসেস চৌধুরী বললেন, ‘আসুন।’
বসবার ঘরটি পরিপাটিভাবে সাজানো; নীচু চেয়ার, সোফা, সেন্টার পিস। দেয়ালে একটি মধ্যবয়স্ক পুরুষের আবক্ষ ফটোগ্রাফ টাঙানো রয়েছে; মুখখানা কঠোর, চোখের নির্মম দৃষ্টি দর্শককে সর্বত্র অনুসরণ করে বেড়াচ্ছে; এ ঘরে থাকলে ওই সন্ধানী দৃষ্টি এড়িয়ে যাবার উপায় নেই।
ব্যোমকেশ ও রাখালবাবু পাশাপাশি সোফায় বসলেন; শ্ৰীমতী চৌধুরী একটি চেয়ারের কিনারায় বসে ভয়ার্তা চোখে তাঁদের পানে চাইলেন।
‘আপনার স্বামীর নাম কি?’
‘তারাকুমার চৌধুরী।’
‘কি কাজ করেন?’
‘ইঞ্জিনীয়র। রেলের ইঞ্জিনীয়র।’
‘ছেলেপুলে?’
‘নেই। আমরা নিঃসন্তান।’
‘কাল রাত্রি সওয়া ন’টার সময় আপনি নিরুপমা হোটেলে গিয়েছিলেন?’
শ্ৰীমতী চৌধুরীর চোখ দু’টি চশমার ভেতরে বিস্ফারিত হলো, ‘আমি! না না, আমি তো সিনেমা দেখতে গিয়েছিলুম।’
‘হোটেলের দরোয়ান আপনাকে কাল দেখেছে, সে আপনাকে সনাক্ত করতে পারবে।’
শ্ৰীমতী চৌধুরীর মুখ শুকিয়ে গেল, তিনি ঠোঁট চেটে বললেন, ‘কিন্তু আমি সিনেমা দেখতে গিয়েছিলুম–আলেয়া সিনেমাতে। টিকিটের প্রতিপত্র দেখাতে পারি।’
‘আপনি সিনেমার টিকিট কিনেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ছবি শেষ হবার আগেই নিরুপমা হোটেলে গিয়েছিলেন, রাজকুমার বোসের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।’
রাজকুমারের নাম শুনে শ্ৰীমতী চৌধুরীর মুখ মড়ার মত হয়ে গেল। তাঁর ঠোঁট দুটো অস্ফুটভাবে নড়তে লাগল, ‘রাজকুমার বসু–তাকে তো আমি চিনি না—’
ব্যোমকেশ বন্দুকের গুলির মত প্রশ্ন করল, ‘সুকান্ত সোমকে চেনেন?’
শ্ৰীমতী চৌধুরী জলবদ্ধ হরিণীর মত ব্যোমকেশের পানে চাইলেন, তারপর দু’ হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলেন।
ব্যোমকেশ নরম সুরে বলল, ‘আমরা জানি, রাজকুমার বোস আর সুকান্ত সোম একই ব্যক্তি। সে আপনাকে ব্ল্যাকমেলা করছিল। কাল রাত্রি সওয়া ন’টার সময় সিনেমা-ফেরত আপনি তাকে টাকা দিতে গিয়েছিলেন। এখন বাকি কথা সব বলুন, আপনার কোনো ভয় নেই।’
শ্ৰীমতী চৌধুরী কিছুক্ষণ ফোঁপালেন, তারপর চোখ মুছে মুখ তুললেন, ভাঙা-ভাঙা গলায় বললেন, ‘বলছি। কেন জানতে চান আপনারাই জানেন, কিন্তু দোহাই আপনাদের, আমার স্বামী যেন কিছু জানতে না পারেন।’
ব্যোমকেশ দেয়ালের ছবির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘ইনি আপনার স্বামী?’
‘হ্যাঁ।’ ‘কড়া প্রকৃতির লোক মনে হয়। কিন্তু আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, নিতান্ত প্রয়োজন না হলে আমরা কাউকে কিছু বলব না।’
তারপর মিসেস চৌধুরী লজ্জানত চোখে দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে যে কাহিনী বললেন তার সারাংশ এই :
বারো-তেরো বছর আগে শ্ৰীমতী চৌধুরী যখন কুমারী ছিলেন তখন তাঁর প্রকৃতি ছিল অন্য রকম, তিনি নিজেকে সংস্কারমুক্ত অতি-আধুনিক মনে করতেন। বাপের বাড়িতে টাকা ছিল বেশি, শাসন ছিল কম। লতিকা চক্রবর্তী বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে হৈ হৈ করে, সিনেমা-থিয়েটার দেখে সময় কাটাতেন।
সে-সময় চিত্র-জগতে সুকান্ত সোম নামে একজন হীরো ছিল, যেমন তার চেহারা তেমনি অভিনয়। লতিকা চক্রবর্তী তার প্রেমে পড়ে গেলেন, সাধারণ প্রেম নয়, একেবারে বাঁধন-ছেড়া প্রেম। তিনি সুকান্তকুমারকে প্রবল অনুরাগপূর্ণ চিঠি লিখতে আরম্ভ করলেন। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা হতে লাগল।
লতিকা সুকাস্তকে বিয়ে করবার জন্যে ক্ষেপে উঠেছিলেন, কিন্তু একদিন জানতে পারলেন, সুকান্তর ঘরে একটি স্ত্রী আছে। তাঁর প্রেমে ভাটা পড়ল। তাঁর বাবা বোধহয় কিছু সন্দেহ করেছিলেন, তিনি তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন।
তারপর দু’বছর কাটল। লতিকা দেবীর স্বামী লোকটি অতিশয় সজ্জন। কিন্তু যৌন শিথিলতা সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী অত্যন্ত কড়া। বিয়ের পর লতিকা চৌধুরীর রোমাঞ্চের নেশা ছুটে গিয়েছিল, স্বামীকে তিনি প্রীতি ও শ্রদ্ধার চোখে দেখতে আরম্ভ করেছিলেন। সন্তানাদি না হলেও তাঁদের দাম্পত্য জীবন সুখের হয়ে উঠেছিল।