রুম নম্বর দুই

একদিন কাগজে ভয়ঙ্কর খবর বেরুল‌, সুকান্ত নিজের স্ত্রীকে খুন করেছে। কেস আদালতে উঠল। আসামী অবশ্য খালাস পেয়ে গেল‌, কারণ সে আত্মরক্ষার্থে খুন করেছে; স্ত্রী ছুরি নিয়ে তাকে আক্রমণ করেছিল‌, তার মুখ এবং সবঙ্গে কেটে ফালা-ফালা করে দিয়েছিল‌, সে নিজের প্ৰাণ বাঁচাবার জন্যে স্ত্রীকে গলা টিপে মেরেছে। যতদিন মোকদ্দমা চলেছিল। ততদিন লতিকা দেবী ভয়ে কাঁটা হয়ে ছিলেন‌, পাছে কোনো সূত্রে তাঁর নামটা প্রকাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু সাক্ষী বা আসামী কেউ তাঁর নাম করল না; তখন তিনি নিশ্চিন্ত হলেন।

অতঃপর দু-তিন বছর নিরুপদ্রবে কেটে গেল।

সুকান্তর সিনেমার কাজ শেষ হয়েছিল; ও রকম একটা মুখ নিয়ে সিনেমার হীরো সাজা যায় না। সে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়েছিল। হঠাৎ একদিন সুকান্ত তার বীভৎস মুখ নিয়ে লতিকা দেবীর সঙ্গে দেখা করল‌, বলল‌, ‘আমার টাকার দরকার‌, তোমাকে দিতে হবে। বেশি নয়‌, ছাঁ মাস অন্তর তিন শো টাকা; তোমার পক্ষে অতি সামান্য। যদি না দাও‌, তুমি আমাকে যে-সব চিঠি লিখেছিলে সেগুলি তোমার স্বামীকে দেখাব।’

সেই থেকে শ্ৰীমতী চৌধুরী ছ’ মাস অন্তর তিন শো টাকা গুনছেন। ছ’ মাসে তিন শো টাকা তাঁর গায়ে লাগে না‌, কিন্তু সদাই ভয়‌, পাছে স্বামী জানতে পারেন।

কাল রাত্রে তিনি টাকা দিতে নিরুপমা হোটেলে গিয়েছিলেন, দু’নম্বর ঘরের দোরের বাইরে থেকে সুকান্ত সোমকে টাকা দিয়ে চলে এসেছিলেন। আর কিছু জানেন না।

শ্ৰীমতীর কাহিনী শেষ হলে শ্রোতা দু’জন কিছুক্ষণ নীরবে বসে রইলেন। তারপর ব্যোমকেশ নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। বলল‌, ‘আচ্ছা‌, আজ আমরা যাই। একটা সুখবর দিয়ে যাই‌, কাল রাত্রি সওয়া নটা থেকে এগারোটার মধ্যে সুকান্ত সোম ওরফে রাজকুমার বোস খুন হয়েছে।’

বাড়ি থেকে বেরিয়ে দু’জনে ফুটপাথে এসে দাঁড়ালেন। রাখালবাবু বললেন‌, ‘শ্ৰীমতীর আত্মকথা তো শুনলাম। কিন্তু খুনের হদিস পাওয়া গেল না।’

ব্যোমকেশ বলল‌, ‘একেবারে কিছুই পাওয়া যায়নি এমন কথা বলা যায় না। আজ যতগুলি লোকের এজেহার শুনেছি তাদের মধ্যে একজন একটা বেফাঁস কথা বলেছে। কিন্তু কে বলেছে। মনে করতে পারছি না।’

‘কী বেফাঁস কথা?’

‘সেইটেই মনে আসছে না। অনেক কথার মধ্যে ওই কথাটা মগ্নচৈতন্যে ডুব মেরেছে।’

রাখালবাবু ঘড়ি দেখলেন‌, প্রায় তিনটে বাজে। বললেন‌, ‘আমি এখন থানায় ফিরব। আপনি?’

‘আমি একবার নতুন বাড়ির কাজকর্ম তদারক করে বাসায় ফিরব। কাল সকালে আবার দেখা হবে। ইতিমধ্যে যদি নতুন খবর কিছু পান‌, দয়া করে টেলিফোন করবেন।’

পাঁচটার পর বাসায় ফিরে ব্যোমকেশ এক পেয়ালা চা খেল‌, তারপর সিগারেট ধরিয়ে তক্তপোশের ওপর লম্বা হলো। অজিত বাড়ি নেই‌, সাড়ে চারটের সময় দোকানে গেছে। ব্যোমকেশ একলা একলা চোখ বুজে শুয়ে সিগারেট টানতে লাগল।

সাড়ে ছাঁটার সময় সে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। সত্যবতী কী একটা কাজে ঘরে এসেছিল‌, চমকে উঠে বলল‌, ‘কি হলো?’

ব্যোমকেশ উদ্ভাসিত মুখে বলল‌, ‘মনে পড়েছে!’

‘কী মনে পড়ল?’

‘কাছে এসো‌, কানে কানে বলছি।’

কানে কানে কথা শুনে সত্যবতী হাসিমুখে ব্যোমকেশের বাহুতে একটি ছোট্ট চড় মারল। ব্যোমকেশ উঠে দাঁড়িয়ে বলল‌, ‘আমাকে একবার বেরুতে হবে।’

‘আবার বেরুবে। কোথায় যাবে?’

‘কালকেতু খবরের কাগজের অফিসে। দশ বছরের পুরনো কাগজের ফাইল দেখতে হবে।’

‘ফিরতে নিশ্চয় রাত করবে। জলখাবার খেয়ে যাও।’

‘দরকার নেই। পেটে নিরুপমা হোটেলের গদ আছে।’

পরদিন সকালবেলা ব্যোমকেশ রাখালবাবুকে টেলিফোন করল‌, ‘তাজা খবর কিছু আছে নাকি?’

রাখালবাবু বললেন‌, ‘সাড়া-জাগানো কোনো খবর নেই। লাশ পরীক্ষা করে অপ্রত্যাশিত কোনো খবর পাওয়া যায়নি; মৃত্যুর সময় ডিনারের আন্দাজ দেড় ঘণ্টা পরে। দুনম্বর ঘরে রাজকুমার আর গুণধরের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। — শ্যামাকান্ত লাহিড়ীর বাসায় আবার গিয়েছিলাম; সে পরিষ্কার অস্বীকার করল‌, বলল‌, নিরুপমা হোটেলে যায়নি। জেনারেল রামপিরিত কিন্তু তাকে সনাক্ত করেছে। শ্যামাকাস্তকে অ্যারেস্ট করিনি‌, কিন্তু তার পেছনে লেজুড় লাগিয়েছি।’

‘তারপর?

‘জগবন্ধু পাত্রের আসল নাম জানা গিয়েছে–ভগবান মহান্তি। দাগী আসামী; মেদিনীপুরে একটা স্ত্রীলোককে খুন করে চৌদ্দ বছর জেলে গিয়েছিল‌, তারপর জেল ভেঙে পালায়। কলকাতায় এসে ছদ্মনামে ঘোড়দৌড়ের দালালি করছিল।’

‘আর কিছু?’

‘লিতিকা দেবীর স্বামী তারাকুমার চৌধুরী সম্বন্ধে খোঁজখবর নিয়ে জানলাম। তিনি সে-রাত্রে এগারোটার পর বাড়ি ফিরেছিলেন। কিন্তু এতক্ষণ কোথায় ছিলেন জানা যাচ্ছে না।’

‘জানার দরকার নেই। হোটেলের খবর কি?’

‘হোটেলের অতিথিরা বড় অস্থির হয়ে উঠছেন। ভাবছি আজ বিকেলবেলা তাদের ছেড়ে দেব।–আপনি কিছু পেলেন?’

‘পেয়েছি। আমি এখনি নিরুপমা হোটেলে যাচ্ছি। আপনিও আসুন।’

এক নম্বর ঘরের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রাখালবাবু ও ব্যোমকেশের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হলো। রাখালবাবু দোরে টোকা দিলেন।

দোর খুলে গেল। মিসেস শোভনা রায় রাখালবাবুকে দেখে জ্বলে উঠলেন‌, ‘এই যে। আপনি আর কতদিন আমাকে আটকে রাখবেন। আমার মত একজন ডাক্তারকে এমনভাবে আটকে রাখা আইনবিরুদ্ধ তা জানেন কি?’

রাখালবাবু বললেন‌, ‘আমার বিরুদ্ধে আপনার যদি কোনো নালিশ থাকে আদালত আছে। আপাতত আপনাকে আমরা দু-চারটে কথা বলতে চাই।’

দু’জনে ঘরে প্রবেশ করলেন‌, ব্যোমকেশ চেয়ারে বসে বলল‌, ‘আপনাকে একটা গল্প শোনাতে চাই‌, মিসেস রায়।’

0 Shares