রুম নম্বর দুই

মিসেস বায় আবার জ্বলে উঠলেন‌, রূঢ়কণ্ঠে বললেন‌, ‘আপনি আবার কে! ঠাট্টা করছেন নাকি?’

রাখালবাবু বললেন‌, ‘ইনি ব্যোমকেশ বক্সী। নাম শুনে থাকবেন।’

ব্যোমকেশ বলল‌, ‘ঠাট্টা করছি না‌, মোটেই ঠাট্টা করছি না। আপনি বসুন।’

ব্যোমকেশের নাম শুনে মিসেস রায় থতিয়ে গিয়েছিলেন‌, খাটের ধারে বসলেন। রুক্ষ স্বর যথাসম্ভব নরম করে বললেন‌, ‘কি বলবেন বলুন। আমি কিন্তু আজই বহরমপুর ফিরে যাব।’

ব্যোমকেশ বলল‌, ‘সেটা ভবিষ্যতের কথা।—গল্পটি খবরের কাগজে পড়লাম‌, সংক্ষেপে শোনাচ্ছি। —সুকান্ত সোম একজন সিনেমা আর্টিস্ট ছিল—’

মিসেস রায়ের শরীর শক্ত হয়ে উঠল‌, তিনি অপলক চক্ষে ব্যোমকেশের পানে চেয়ে রইলেন। ব্যোমকেশ শুষ্ক স্বরে বলল‌, ‘চেনেন দেখছি। চেনবারই কথা‌, সে আপনার জামাই ছিল। —সুকান্ত সোম সিনেমা করে খুব নাম করেছিল। আপনি তখন বর্ধমানে প্র্যাকটিস করতেন। বিধবা মানুষ‌, সংসারে কেবল একটি মেয়ে। বর্ধমানে সুকাস্তের যাওয়া-আসা ছিল। সে একদিন আপনার মেয়েটিকে ভুলিয়ে নিয়ে ইলোপ করল। সুকান্ত আপনার মেয়েকে লোভ দেখিয়েছিল তাকে সিনেমার হিরোইন করবে। আপনি সুকান্তকে পছন্দ করতেন না‌, তাই ইলোপমেন্ট।

‘একসঙ্গে কিছু দিন বাস করবার পর দু’জনের প্রকৃত চরিত্র প্রকাশ হয়ে পড়ল; দু’জনেরই মিলিটারি মেজাজ। ঝগড়া আরম্ভ হলো। ঝগড়ার প্রধান কারণ‌, সুকান্ত আপনার মেয়েকে হিরোইন বানাতে পারেনি। একদিন ঝগড়া চরমে উঠল‌, আপনার মেয়ে ছুরি দিয়ে সুকান্তর মুখ কেটে ফালা-ফালা করে দিল। সুকান্ত নিজের প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে আপনার মেয়েকে গলা টিপে খুন করল।

‘খুনের আসামী সুকান্ত তিন মাস পুলিসের হাসপাতালে রইল। সেখান থেকে তাকে যখন বিচারের জন্যে আদালতে হাজির করা হলো তখন তার বীভৎস মুখ দেখে জজ সাহেব পর্যন্ত চমকে গেলেন। জেলের হাসপাতালে প্লাস্টিক সাজারির ব্যবস্থা নেই; সুকান্তর মুখের ঘা শুকিয়েছে বটে‌, কিন্তু সিনেমার হিরোর পার্ট করার মত মুখ আর নেই।

‘বিচার হলো। আপনি সুকান্তর বিরুদ্ধে সাক্ষী ছিলেন‌, মিসেস রায়। কিন্তু তাকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাতে পারলেন না। তার হাতে অস্ত্র ছিল না‌, আপনার মেয়ের হাতে অস্ত্র ছিল; আত্মরক্ষার অজুহাতে সুকান্ত ছাড়া পেয়ে গেল।’—

মিসেস শোভনা রায় আগুন-ভরা চোখে বললেন‌, ‘মিছে কথা। ও আগে আমার মেয়েকে গলা টিপে মেরেছিল‌, তারপর নিজে নিজের মুখ ছুরি দিয়ে কেটেছিল।’‌,

ব্যোমকেশ মাথা নেড়ে বলল‌, ‘কথাটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সুকান্ত সিনেমা আর্টিস্ট‌, সে কখনো নিজের মুখে ছুরি মেরে নিজের আখের নষ্ট করত না; নিজের গায়ে ছুরি মারত। যাহোক‌, সুকান্ত খুনের দায় থেকে রেহাই পেল বটে‌, কিন্তু তার সিনেমা-জীবন শেষ হয়ে গেল। সৎপথে থেকে অন্য কোনো উপায়ে জীবিকা অর্জনের রাস্তা সে জানত না‌, সে কলকাতা থেকে পালিয়ে গিয়ে পাটনায় বাসা বাঁধিল এবং ব্ল্যাকমেলের ব্যবসা শুরু করল। গত দশ বছরে কলকাতায় কটকে কাশীতে দিল্লীতে তার অনেক খদ্দের জুটেছে। কারুর ওপর সে অযথা উৎপীড়ন করে না‌, ছ’ মাস অন্তর এসে বাঁধা-বরাদ্দ আদায় তসিল করে। এই তার জীবিকা।

‘সুকান্ত যখন আদায় তসিলের জন্যে কলকাতায় আসত তখন এই নিরুপমা হোটেলেই থাকত। আপনি ইতিমধ্যে বর্ধমানের বাস তুলে দিয়ে বহরমপুরে গিয়ে প্র্যাকটিস শুরু করেছেন‌, আপনিও মাঝে-মধ্যে এসে এই হোটেলে থাকেন। কিন্তু ঠিক একই সময়ে দু’জনের আসা আগে ঘটেনি‌, আপনি সুকান্তকে এখানে দেখেননি।

‘দৈবক্রমে এবার আপনি তাকে দেখতে পেলেন‌, সে আপনার পাশের ঘরেই উঠেছে। সে বোধ হয় আপনাকে দেখতে পায়নি। পেলে সাবধান হতো। আপনি তাকে পেলে খুন করবেন। এই ধরনের একটা ইচ্ছে আপনার মনে ছিল‌, কিন্তু দশ বছর সে-আগুন ছাই-চাপা পড়েছিল। এখন সুকান্তকে হাতের কাছে পেয়ে ছাই-চাপা আগুন দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠল। আপনার মেয়েকে যে খুন করেছে তাকে আপনি বেঁচে থাকতে দেবেন না। আপনার মেয়ে বোধ হয় আপনার কাছ থেকেই তার উগ্র হিংস্র প্রকৃতি পেয়েছিল।

‘সে-রাত্রে ডিনার খেয়ে এসে আপনি নিজের ঘরে অপেক্ষা করে রইলেন। কিভাবে তাকে খুন করবেন তার প্ল্যান ঠিক করে ফেলেছেন; এখন শুধু শুভমুহূর্তের অপেক্ষা।

‘সওয়া নটা থেকে সুকান্তর ঘরে লোক আসতে শুরু করল। আপনি নিজের ঘরে ওত পেতে আছেন। দশটার সময় লোক আসা বন্ধ হলো। আপনি অস্ত্র হাতে নিয়ে বেরুলেন। দোতলার অন্য অতিথিরা দোর বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে‌, যে-চাকরটা সিঁড়ির সামনে শোয় সে এখনো আসেনি। এই সুযোগ।

‘আপনি দু’ নম্বর দোরে টোকা দিলেন। সুকান্ত তখন শুয়ে পড়েছিল‌, সে উঠে দোর খুলল; আপনি সঙ্গে সঙ্গে তার বুকে অস্ত্রটা ঢুকিয়ে দিলেন। তারপর দোর টেনে বন্ধ করে নিজের ঘরে ফিরে এলেন। আপনার সঙ্গে যে রাজকুমার বোসের সম্বন্ধ আছে তা কেউ জানে না‌, আপনাকে কে সন্দেহ করতে পারে! বরং রাত্রে যারা রাজকুমারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল‌, সন্দেহ পড়বে তাদের ওপর।

‘আপনি একটি ছোট্ট ভুল করেছিলেন। ইন্সপেক্টর যখন আপনাকে জেরা করেন তখন আপনি বলেছিলেন‌, রাজকুমারকে আপনি আগে কখনো দেখেননি; তার পরেই বললেন‌, ও মুখ দেখলে মনে থাকত। রাজকুমারের মুখ যে মনে রাখার মত তা আপনি জানলেন কি করে? ঘরের দিকে

রাজকুমারের মুখ আপনি দেখতে পাননি। এই বেফাঁস কথাটা যদি আপনি না বলতেন তাহলে দশ বছরের পুরনো খবরের কাগজের ফাইল দেখার কথা আমার মনে আসত না।’

এই পর্যন্ত বলে ব্যোমকেশ চুপ করল। মিসেস রায় কামারের হাপরের গানগনে আগুনের মত জুলতে লাগলেন। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বললেন‌, ‘সব মিছে কথা। সুকান্ত আমার মেয়েকে খুন করেছিল‌, কিন্তু আমি তাকে খুন করিনি। কি দিয়ে খুন করব? আমার কাছে কি ছোরা-জুরি আছে?’

ব্যোমকেশ তাঁর ডাক্তারি ব্যাগের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল‌, ‘আছে। ওই ব্যাগের মধ্যে আছে।’

মিসেস রায়ের চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে গেল।

‘না‌, নেই। এই দেখুন—’

ব্যাগ খুলে ক্ষিপ্র হস্তে তার ভিতর থেকে তিনি একটি কাঁচি বার করলেন। লম্বা লিকলিকে সার্জিকাল কাঁচি‌, তার দুটো ফলা আলাদা করা যায়। মিসেস রায় কাঁচির একটা ফলা খুলে নিয়ে নিজের বুকে বসিয়ে দিতে গেলেন। কিন্তু রাখালবাবু প্রস্তুত ছিলেন‌, তিনি বিদ্যুৎবেগে মিসেস রায়ের মণিবন্ধ চেপে ধরলেন। মিসেস রায় উন্মত্ত কণ্ঠে চীৎকার করে উঠলেন‌, ‘ছেড়ে দাও–ছেড়ে দাও

ব্যোমকেশ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল‌, ‘যাক‌, অস্ত্রটাও পাওয়া গেছে। ওটা না পেলে মুশকিল। হতো।’

(সমাপ্ত)

0 Shares