লোহার বিস্কুট

‘তারপর প্রায় বছরখানেক ভারি আরামে কেটেছে। স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে এলাম, সারা বাড়িটা দখল করে দিব্যি হাত-পা ছড়িয়ে বাস করছি। বাড়ির ভাড়া মাসে মাসে অক্ষয় মণ্ডলের খাতায় জমা করে দিই। তার টেবিল চেয়ার ইত্যাদি ব্যবহার করি বটে কিন্তু আলমারি বাক্স কাবার্ডে হাত দিই না, পুলিস খানাতল্লাশ করার পর যেমনটি ছিল তেমনি আছে।

‘হঠাৎ মাস দুই আগে এক ফ্যাসাদ উপস্থিত হল। সকালবেলা নীচের ঘরে বসে কাগজ পড়ছি, একজন অপরিচিত লোক এল, তার সঙ্গে একটি স্ত্রীলোক। ভদ্রশ্রেণীর মধ্যবয়স্ক পুরুষ, স্ত্রীলোকটি সধবা। পুরুষ স্ত্রীলোকটির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “এ হচ্ছে অক্ষয় মণ্ডলের স্ত্রী, আমি ওর বড় ভাই। এতদিন আমি ওকে পুষেছি, কিন্তু আর আমার পোষবার ক্ষমতা নেই। এবার ও স্বামীর বাড়িতে থাকবে। আপনাকে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে।”

‘মাথায় বজ্রপাত। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। তারপর বুদ্ধি গজালো, বললাম, “অক্ষয়বাবুর স্ত্রী আছেন, তা কোনদিন শুনিনি। যদি আপনাদের কথা সত্যি হয়, আপনি আদালতে গিয়ে নিজের দাবি প্রমাণ করুন, তারপর দেখা যাবে।”

‘কিছুক্ষণ বকাবকি কথা-কাটাকাটির পর তারা চলে গেল। আমার সন্দেহ হল এরা দাগাবাজ জোচ্চোর, ছলছুতো করে বাড়িটা দখল করে বসতে চায়। আজকাল বাসাবাড়ির যে রকম ভাড়া দাঁড়িয়েছে, ফোকটে বাসা পেলে কে ছাড়ে!

‘থানায় গিয়ে খবরটা জানিয়ে এলাম। দারোগাবাবু বললেন, “অক্ষয় মণ্ডলের স্ত্রী আছে কিনা আমাদের জানা নেই। যাহোক, আমার যদি আসে, ছলছুতো করে থানায় নিয়ে আসবেন। আমরাও বাড়ির ওপর নজর রাখব।”

‘আমার পিস্তল আছে, তাছাড়া একটা কুকুর পুষেছি। হিংস্র পাহাড়ী কুকুর, নাম ভুটো; আমার হাতে ছাড়া কারুর হাতে খায় না। আমি ব্যাঙ্কে যাবার সময় তার শেকল খুলে দিই, রাত্তিরে তাকে ছেড়ে দিই, সে বাড়ি পাহাড়া দেয়। ভুটো ছাড়া থাকতে বাড়িতে চোর-ছাঁচড় ঢোকার ভয় নেই, ভুটো তাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। তবু এই ঘটনার পর মনে একটা অস্বস্তি লেগে রইল। অক্ষয় মণ্ডল লোক ভাল নয়, হয়তো নিজে আড়ালে থেকে কোনো কুটিল খেলা খেলছে।

‘দিন দশেক পরে একখানা বেনামী চিঠি পেলাম, “পাড়া ছেড়ে চলে যাও, নইলে বিপদে পড়বে।”–পাড়া মানেই বাড়ি। থানায় গিয়ে চিঠি দেখালাম। দারোগাবাবু বললেন, “চেপে বসে থাকুন, বড়বেন না। আপনার বাসার ওপর পাহারা বাড়িয়ে দিচ্ছি।”

‘তারপর থেকে এই দেড় মাস আর কেউ আসেনি, উড়ো চিঠিও পাঠায়নি। এখন বেশ নিরাপদ বোধ করছি। কিন্তু একটি সমস্যার উদয় হয়েছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্যই আপনার কাছে আসা। দারোগাবাবুর কাছে যেতে পারতাম, কিন্তু তিনি হয়তো এমন উপদেশ দিতেন যা আমাদের পছন্দ হত না।

‘ব্যাপারটা এই : ব্যাঙ্ক থেকে আমার এক মাসের ছুটি পাওয়া হয়েছে। আমার স্ত্রীর অনেক দিন থেকে তীর্থে যাবার ইচ্ছে। হরিদ্বার, হৃষিকেশ এইসব। ব্যাঙ্কের একটি সহকর্মীও আমার সঙ্গেই ছুটি নিয়ে কুণ্ডু স্পেশালে বেড়াতে বেরুচ্ছেন, আমাকেও তিনি সঙ্গে যাবার জন্য চাপাচাপি করছেন। দল বেঁধে গেলে অনেক সুবিধে হয়। আমার স্ত্রী খুব উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন। আমার উৎসাহও কম নয়। কিন্তু–

‘যেতে হলে বাড়িতে তালা বন্ধ করে যেতে হবে। ভুটোকেও মাসখানেকের জন্যে একটা কেনেলে ভর্তি করে দিতে হবে। বাড়ি অরক্ষিত থাকবে। মনে করুন, এই ফাঁকে অক্ষয় মণ্ডলের বৌ–মানে, ওই স্ত্রীলোকটা যদি তালা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে বাড়ি দখল করে বসে, তখন আমি কি করব? অক্ষয় মণ্ডলের মৌখিক অনুমতি ছাড়া আমার তো কোনো হক নেই। তবে আমি দখলে আছি, আমাকে বেদখল করতে হলে ওদের আদালতে যেতে হবে। কিন্তু ওরা যদি দখল নিয়ে বসে, তখন আমি কোথায় যাব?

‘এই আমার সমস্যা। নিতান্তই ঘরোয়া সমস্যা। আপনার নিরীক্ষার উপযুক্ত নয়। তবু রথ-দেখা কলা-বেচা দুই-ই হবে, এই মতলবে আপনার কাছে এসেছি। এখন বলুন, বাড়িখানি রেখে আমাদের তীর্থযাত্রা করা উচিত হবে কিনা।”

ব্যোমকেশ খানিকক্ষণ গালে হাত দিয়ে বসে রইল, শেষ বলল, “আপনাদের তীর্থযাত্রায় বাধা দিলে পাপ হবে, আবার বাড়ি বেহাত হয়ে যাওয়াও বাঞ্ছনীয় নয়। আপনার জানাশোনার মধ্যে এমন মজবুত লোক কি কেউ নেই, যাকে বাড়িতে বসিয়ে তীর্থযাত্রা করতে পারেন?”

‘কই, সে রকম কাউকে দেখছি না। সকলেরই বাসা আছে। যাদের নেই তাদের বসাতে সাহস হয় না, শেষে খাল কেটে কুমীর আনব।’

‘তাহলে চলুন, আপনার বাসাটা দেখে আসি।’ ব্যোমকেশ উঠে দাঁড়াল।

কমলবাবু উৎফুল্ল চোখে চাইলেন, ‘যাবেন! কী সৌভাগ্য! চলুন চলুন, বেশি দূর নয়–‘

‘একটু বসুন। বেশি দূর না হলেও রোদ বেশ কড়া। একটা ছাতা নিয়ে আসি।’

ব্যোমকেশ ভিতরে গিয়ে ছাতা নিয়ে এল। ছাতাটি ব্যোমকেশের প্রিয় ছাতা; অতিশয় জীর্ণ, লোহার বাঁট এবং কামানিতে মরচে ধরেছে, কাপড় বিবর্ণ এবং বহু ছিদ্রযুক্ত। এই ছাতা মাথায় দিয়ে রাস্তায় বেরুলে নিজে অদৃশ্য থেকে সন্দেহভাজন ব্যক্তির অনুসরণ করা যায়; ফুটো ফিয়ে বাইরের লোককে দেখা যায়, কিন্তু বাইরের লোক ছাতাধারীর মুখ দেখতে পায় না। সত্যান্বেষীর উপযুক্ত ছাড়া।

‘চলুন।’

কমলবাবুর বাসা ব্যোমকেশের বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেকের রাস্তা। মাঝে মাঝে এ পথ দিয়ে যাবার সময় বাড়িটি ব্যোমকেশের চোখে পড়েছে; ছোট দোতলা বাড়ি; কিন্তু একটি বিশেষত্বের জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করে; সমস্ত ছাদ লোহার ডাণ্ডা-ছত্রী দিয়ে ঢাকা, যেন প্রকাণ্ড একটা লোহার খাঁচা। বাইরে থেকে কোনো মতেই ছাদের ওঠা সম্ভব নয়।

0 Shares