লোহার বিস্কুট

‘আসুন।’

ছাতা মুড়ে ব্যোমকেশ বাড়িতে ঢুকল। কমলবাবু প্রথমে তাকে নীচের তলায় বসবার ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে একটি শতরঞ্জি-ঢাকা তক্তপোশ ও দু’টি ক্যাম্বিসের চেয়ার ছাড়া আর বিশেষ কিছু নেই। ব্যোমকেশ ঘরের চারিদিকে চোখ ফেরাল। সে যেন একটা সূত্র খুঁজছে, কিন্তু এই নগ্নপ্রায় ঘরে কোনো অঙ্গুলিনির্দেশ পাওয়া গেল না। সে বলল, ‘নীচের তলায় আর একটা ঘর আছে, না?’

‘আছে। ঘরটা অক্ষয় মণ্ডলের আমলে ব্যবহার হত না, আমি ওটাকে রান্নাঘর করেছি। দেখবেন?’

‘দরকার নেই। আপনার স্ত্রী বোধ হয় এখন রান্নাবান্না করছেন। চলুন, ওপরতলাটা দেখা যাক।’

‘চলুন।’

ঘরের লাগাও একটা সরু বারান্দার শেষে ওপরে ওঠার সিঁড়ি, সিঁড়ির মাথায় দরজা।

দরজার মাথায় ওপরকার দেয়ালে ঘোড়ার ক্ষুরের নালের মত লোহার একটা জিনিস তিনটে পেরেকের মাঝখানে আটকানো রয়েছে। ব্যোমকেশ সেই দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ছাতা তুলে সেই দিকে নির্দেশ করে বলল, ‘ওটা কি?’

‘ওটা ঘোড়ার নাল। বিলিতি কুসংস্কার অনুযায়ী দোরের মাথায় ঘোড়ার নাল টাঙিয়ে রাখলে নাকি অনেক টাকা হয়।’

ব্যোমকেশের ছাতার ডগা ঘোড়ার নালে আটকে গিয়েছিল, সে টেনে সেটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘এটা কি আপনি লাগিয়েছেন নাকি?’

‘না, অক্ষয় মণ্ডলের আমল থেকে আছে।’

ব্যোমকেশ ঘোড়ার নালের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন স্বপ্নাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। কমলবাবু ডাকলেন, ‘ভেতরে আসুন।’

ঘরের ভিতর কমলবাবুর দশ বছরের মেয়ে মেঝেয় মাদুর পেতে বসে লেখাপড়া করছিল, তার কাছে মাদুরের বাইরে একটা ভীষণদর্ষন কুকুর থাবা পেতে বসেছিল, ব্যোমকেশের পানে মণিহীন নীলাভ চোখ তুলে চাইল। কমলবাবু বললেন, ‘খুকু, যাও তোমার মাকে চা তৈরি করতে বল, আর কিছু ভাজাভুজি।’

ব্যোমকেশ একটু আপত্তি করল, কিন্তু কমলবাবু শুনলেন না। খুকু নীচে চলে গেল, ভূটো সঙ্গে সঙ্গে গেল।

অতঃপর ব্যোমকেশ ঘরটি চক্ষু দিয়ে সমীক্ষা করল। বলল, ‘এ ঘরে অক্ষয় মণ্ডলের কোনো আসবাবপত্র আছে?’

কমলবাবু বললেন, ‘ছিল, আমি পাশের ঘরে নিয়ে গেছি। খাট এবং দেরাজওয়ালা টেবিল। এই যে।’

পাশের ঘরটি অপেক্ষাকৃত বড়; জানলার দিকে খাট, অন্য কোণে টেবিল। ব্যোমকেশ টেবিলের কাছে গিয়ে বলল, ‘সেই যে পুলিসের খানাতল্লাশে লোহার মোড়ক পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলো কি পুলিস নিয়ে গিয়েছে?’

‘একটা মোড়ক পুলিস নিয়ে গিয়েছিল, বাকিগুলো দেরাজে আছে।’ কমলবাবু নীচের দিকের একটা দেরাজ খুলে বললেন, ‘এই যে!’

দেরাজের পিছন দিকে কয়েকটা মোড়ক পড়ে ছিল, ব্যোমকেশ একটা বের করে নেড়েচেড়ে দেখল। আকৃতি-প্রকৃতি সিগারেট প্যাকেটের অভ্যন্তরস্থ তবকের মতই বটে। সেটা রেখে দিয়ে সে হাসিমুখে বলল, ‘ভারি মজার জিনিস তো! এর ভেতর গোটা দুই বিস্কুট রেখে সুতো দিয়ে বেঁধে দিলে নিশ্চিন্দি। চলুন, এবার ছাদটা দেখে আসা যাক।’

‘ছাদে কিন্তু কিছু নেই!’

‘তা হোক। শূন্যতাই হয়তো অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে।’

‘তাহলে আসুন।’

ছাদে সত্যই কিছু নেই। লোহার ঘেরাটোপ ঢাকা ছাদটা বাঘের শূন্য খাঁচার মত দাঁড়িয়ে আছে। এক কোণে উঁচু পাদপীঠের ওপর লাল রঙের লোহার চৌবাচ্চা; এই চৌবাচ্চা থেকে বাড়িতে কলের জল সরবরাহ হয়। ব্যোমকেশ ছাদের চারিদিক সন্ধিৎসুভাবে পরিক্রমণ করে বলল, ‘ছাদটা আপনারা ব্যবহার করেন না?’

কমলবাবু বললেন, ‘বেশি গরম পড়লে ছাদে এসে শুই। বেশ নিরাপদ জায়গা, চর ঢুকবে সে উপায় নেই।’

‘হুঁ। চলুন, আমার দেখা শেষ হয়েছে।’

নীচে নেমে এলে পর খুকু এসে বলল, ‘বাবা, বসবার ঘরে চা দিয়েছি।’

নীচের তলার ঘরে পাঁপড় ভাজা ও গরম বেগুনি সহযোগে চা পান করতে করতে ব্যোমকেশ বলল, ‘থানার যে দারোগাবাবুর কাছে আপনার যাওয়া-আসা, তাঁর নাম কি?’

কমলবাবু বললেন, ‘তাঁর নামে রাখাল সরকার।’

ব্যোমকেশ মুচকি হাসল। চা শেষ করে সে ছাতা নিয়ে উঠে দাঁড়াল, ‘আচ্ছা, আজ তাহলে উঠি।’

কমলবাবু বললেন, ‘কিন্তু আমাদের তীর্থযাত্রার কি হবে, যাওয়া উচিত হবে কি না, কিছু বললেন না তো।’

‘নিশ্চয় তীর্থযাত্রা করবেন। কবে থেকে আপনার ছুটি?’

‘সামনের শনিবার থেকে।’

‘তাহলে আর দেরি করবেন না, টিকিট কিনে ফেলুন। কোনো ভয় নেই, আপনার বাসা বেদখল হবে না, আমি জামিন রইলাম।–আচ্ছা, চলি।’

‘অ্যাঁ–তাই নাই! ধন্যবাদ ব্যোমকেশবাবু। চলুন, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।’

ব্যোমকেশ বলল, ‘তার দরকার নেই, আমি এখন থানায় যাব। রাখালের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করতে হবে।’

শনিবার সকালবেলা কমলবাবুর বাসা থেকে পুলিসের পাহারা তুলে নেওয়া হল।

কমলবাবু ভুটোকে একটা কেনেলে রেখে এলেন। পুলিস ছাড়াও অন্য একটি পক্ষ বাসার ওপর নজর রেখেছিল, তারা সব লক্ষ্য করল।

বিকেলবেলা কমলবাবু তাঁর স্ত্রী মেয়ে এবং পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে বাসায় চাবি দিয়ে চলে গেলেন, যাবার পথে থানায় রাখালবাবুকে চাবি দিয়ে বলে গেলেন, ‘খিড়কির দোর ভেজিয়ে রেখে এসেছি। এখন আমার বরাত আর আপনাদের হাতযশ।’

সারা দিন বাড়িটা শূন্য পড়ে রইল।

রাত্রি আন্দাজ সাড়ে আটটার সময় ব্যোমকেশকে নিয়ে রাখালবাবু কমলবাবুর বাসার দিকে গেলেন। দু’জনের পকেটেই পিস্তল এবং বৈদ্যুতিক টর্চ।

সরজমিন আগে থাকতেই দেখা ছিল, পাশের বাড়ির পাঁচিল ডিঙিয়ে দু’জনে কমলবাবুর খিড়কি দিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন, খিড়কির দরজা বন্ধ করে দিয়ে পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলেন। কান পেতে শুনলেন, বাড়ি নিস্তব্ধ।

0 Shares