শজারুর কাঁটা

উপক্রম

ব্যাপারটা আরম্ভ হয়েছিল মাস তিনেক আগে এবং কলকাতার দক্ষিণ অঞ্চলেই আবদ্ধ হয়ে ছিল।

গোল পার্কের আড়-পার একটা রাস্তার কোণের ওপর একটি অস্থায়ী চায়ের দোকান। দিনের আলো ফোটবার আগেই সেখানে চা তৈরি হয়ে যায়। মাটির ভাঁড়ে গরম চা। সঙ্গে বিস্কুটও পাওয়া যায়। এই দোকানের অধিকাংশ খদের ট্যাকসি ড্রাইভার‌, বাস কন্ডাক্টর ইত্যাদি। যাদের খুব সকালে কাজে বেরুতে হয় তারা এই দোকানের পৃষ্ঠপোষক।

বুড়ো ভিখিরি ফাগুরাম ছিল এই দোকানের খদের। সে রাত্রে ফুটপাথের একটা ঘোঁজের মধ্যে শুয়ে থাকত‌, ভোর হতে না হতে দোকান থেকে এক ভাঁড় চা আর দু’টি বিস্কুট কিনে তার ভিক্ষাস্থানে গিয়ে বসত। ফাগুরামের বয়স অনেক‌, উপরন্তু সে বিকলাঙ্গ‌, তাই দিনান্তে সে এক টাকার বেশি রোজগার করত।

সেদিন ফান্ধুন মাসের প্রত্যুষে আকাশ থকে তখনো কুয়াশার ঘোর কাটেনি‌, ফাগুরাম দোকান থেকে চায়ের ভাঁড় আর বিস্কুট নিয়ে নিজের জায়গায় এসে বসল। চায়ের দোকানে লোক থাকলেও রাস্তায় তখনো লোক চলাচল আরম্ভ হয়নি।

ফাগুরামের অভ্যাস‌, সে রাস্তার দিকে পিছন ফিরে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে খায়। সে এক চুমুক চা খেয়ে বিস্কুটে একটি ছোট্ট কামড় দিয়েছে‌, তার মনে হল পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। সে পিছন দিকে ঘাড় ফেরালো‌, কিন্তু স্পষ্টভাবে কিছু দেখবার আগেই সে পিঠের দিকে কাঁটা ফোটার মত তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করল। অর্ধভুক্ত বিস্কুট তার হাত থেকে পড়ে গেল। তারপর সব অন্ধকার হয়ে গেল।

ভিক্ষুক ফাগুরামের অপমৃত্যুতে বিশেষ হইচই হল না। দিনের আলো ফুটলে তার মৃতদেহটা পথচারীদের চোখে পড়ল‌, তারা মৃতদেহকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তারপর লাশ স্থানান্তরিত হল। খবরের কাগজের এক কোণে খবরটা বেরুল বটে‌, কিন্তু সেটা মারণাস্ত্রের বৈশিষ্ট্যের জন্যে। ভিক্ষুকের পিঠের দিক থেকে একটা ছয় ইঞ্চি লম্বা শজারুর কাঁটা তার হৃদযন্ত্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সংবাদপত্রে যারা খবরটা পড়ল। তারা এই নিয়ে একটু আলোচনা করল। ভিক্ষুককে কে খুন করতে পারে? হয়তো অন্য কোনো ভিক্ষুক খুন করেছে। কিন্তু শজারুর কাটা কেন? এ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর নেই। পুলিস এ ব্যাপার নিয়ে বেশি দিন মাথা ঘামাল না।

মোসখানেক পরে কিন্তু ভিক্ষুকের অপমৃত্যুর কথাটা আবার সকলের মনে পড়ে গেল। আবার শজারুর কাঁটা। রাত্রে রবীন্দ্র সরোবরের একটা বেঞ্চিতে শুয়ে একজন মুট-মজুর শ্রেণীর লোক ঘুমোচ্ছিল‌, আততায়ী কখন এসে নিঃশব্দে তার বুকের বাঁ দিকে শজারুর কাঁটা বিঁধে দিয়ে চলে গেছে। সকালবেলা যখন লাশ আবিষ্কৃত হল তখন মৃতদেহ শক্ত হয়ে গেছে। মৃতের পরিচয় তখনো জানা যায়নি।

এবার সংবাদপত্রের সামনের দিকেই খবরটা বেরুল এবং বেশ একটু সাড়া জাগিয়ে তুলল। ছোরাজুরির বদলে শজারুর কাঁটা দিয়ে খুন করার মানে কি! খুনী কি পাগল? ক্রমে মৃত ব্যক্তির পরিচয় বেরুল‌, তার নাম মঙ্গলরাম; সে সামান্য একজন মজুর‌, তার থাকবার জায়গা ছিল না‌, তাই যখন যেখানে সুবিধা হত। সেখানে রাত কাটাত। তার শত্ৰু কেউ ছিল না‌, অন্তত খুন করতে পারে এমন শত্ৰু ছিল না। পুলিস দু-চার দিন তল্লাশ করে হাল ছেড়ে দিল।

তৃতীয় দিনের ঘটনাটা হল আরো দু’ হস্তী পরে। গরম পড়ে গেছে‌, দিন বাড়ছে‌, রাত কমছে।

গুণময় দাসের জীবনে সুখ ছিল না। তাঁর একটি ছোট মনিহারীর দোকান আছে‌, একটি ছোট পৈতৃক বাস্তুভিটা আছে আর আছে একটি প্রচণ্ড দাজ্জাল বউ। তার চল্লিশ বছর বয়সেও ছেলে।পুলে হয়নি‌, হবার আশাও নেই। তাই রসের অভাবে তাঁর জীবনটা শুকিয়ে ঝামা হয়ে গিয়েছিল। তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে মদ ধরেছিলেন। জীবন যখন শুকায়ে যায় তখন ওই বস্তুটি নাকি করুণাধারায় নেমে আসে।

রাত্রি আটটার সময় গুণময়বাবু দোকান বন্ধ করে বাড়ির অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন। বাড়ি ফিরে যাবার জন্যে তাঁর প্রাণে কোনো উৎসাহ ছিল না‌, বরং বাড়ি ফিরে গিয়ে আজ তিনি স্ত্রীর কোন প্রলয়ঙ্কর মূর্তি দেখবেন এই চিন্তায় তাঁর পদক্ষেপ মন্থর হয়ে আসছিল। তারপর সামনেই যখন মদের দোকানের দরজা খোলা পাওয়া গেল তখন স্যুট করে সেখানে ঢুকে পড়লেন।

এক ঘণ্টা পরে দোকান থেকে বেরিয়ে তিনি আবার গড়িয়ার দিকে চললেন; ওই দিকেই তাঁর বাড়ি। যেতে যেতে তাঁর পা একটু টলতে লাগল‌, তিনি বুঝলেন আজ মাত্রা একটু বেশি হয়ে গেছে। স্ত্রী যদি বুঝতে পারে‌, যদি মুখে গন্ধ পায়–

আরো কিছু দূর যাবার পর রবীন্দ্র সরোবরের রেলিং আরম্ভ হল রাস্তার ডান পাশে। পথে লোকজন বেশি নেই‌, লেকের অন্ধকার এবং রাস্তায় আলো মিলে একটা অস্পষ্ট কুজাঝটিকার সৃষ্টি করেছে।

গুণময়বাবু রাস্তার একটা নিরিবিলি অংশে এসে লেকের দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন‌, রেলিং-এ হাত রেখে প্যাঁচার মত চক্ষু মেলে ভিতরের দিকে চেয়ে রইলেন।

একটি লোক গুণময়বাবুর কুড়ি-পঁচিশ হাত পিছনে আসছিল; সে গুণময়বাবুর পদসঞ্চারের টলমল ভাব লক্ষ্য করেছিল। তাই তিনি যখন রেলিং ধরে দাঁড়ালেন তখন সেও বিশ-পাঁচিশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাঁকে নিরীক্ষণ করে অলস পদে তাঁর দিকে অগ্রসর হল।

লোকটি যখন গুণময়বাবুর পিছনে এসে দাঁড়াল তখনো তিনি কিছু জানতে পারলেন না। লোকটি এদিক ওদিক চেয়ে দেখল লোক নেই। সে পকেট থেকে শলাকার মত একটি অস্ত্র বার করল‌, অস্ত্রটিকে আঙুল দিয়ে শক্ত করে ধরে গুণময়বাবুর পিঠের বা দিকে পাঁজরার হাড়ের ফাঁক দিয়ে গভীরভাবে বিধিয়ে দিল। গুণময়বাবুর গায়ে মলমলের পাঞ্জাবি ছিল‌, শলাকা সটান তাঁর হৃদযন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করল।

50 Shares