দেবাশিসের বাড়িতে স্ত্রীলোক নেই, দীপার কয়েকটি প্রতিবেশিনী সখী এসে ফুলশয্যা সাজিয়ে দিয়ে গেল। অনেক রাত্রি পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া আমোদ-আহ্লাদ চলল। নৃপতির দলই আসর জমিয়ে রাখল। সুজন শুধুই চিত্রাভিনেতা নয়, সে নানারকম ম্যাজিক দেখাল। প্রবাল আজ আর কোনো অশিষ্টতা করল না, নিজে থেকেই গান গেয়ে শোনাল। সকলেই নববধূকে নানা রকম উপহার দিল। নৃপতি দিল সোনার রিস্টওয়াচ, কপিল দিল দামী একটা ঝরনা কলম, খড়্গ বাহাদুর দিল নেপালে তৈরি ঝকঝকে ধারালো কুকরি ছোরা, প্রবাল দিল তার নিজের গাওয়া কয়েকটা গানের রেকর্ড, সুজন দিল একটি রূপোর সরস্বতী মূর্তি। দেবাশিসের ফ্যাক্টরির বন্ধুরাও যথাযোগ্য উপহার দিলেন।
বউভাতের উৎসব শেষে অতিথির দল যখন বিদায় নিল তখন রাত বারোটা বেজে গেছে। বুলি নীচের তলায় রইল। ভূত নকুল, আর দোতলায় দেবাশিস এবং দীপা। প্রথম মিলন শেষ রাত্রি।
অতিথিকে বিদায় দিয়ে দেবাশিস ওপরতলায় গিয়ে দেখল, সব ঘরে বড় বড় আলো জ্বলছে; বসবার ঘরের একটা চেয়ারে দীপা শক্ত হয়ে বসে আছে। দেবাশিস তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দেবাশিসের স্বভাব, যা সম্ভাব্য তাই তার মন স্বীকার করে নেয়, বিলক্ষণতার দিকে সহজে তার দৃষ্টি পড়ে না। সে দীপার দিকে দু’ হাত বাড়িয়ে স্নিগ্ধ হেসে বলল–’এস।’
দীপা চকিতে একবার চোখ তুলল; তার চোখে ভয়ের ছায়া। দেবাশিস ভাবল, কুমারী মনের স্বাভাবিক লজ্জা। সে দীপর পাশের চেয়ারে বসে তার হাতের ওপর হাত রাখল, বলল–’বারোটা বেজে গেছে, আর কতক্ষণ বসে থাকবে। চল, শোবার সময় হল।’
দীপা হাত সরিয়ে নিল। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, তবু যা বলবার তা বলতে হবে, আর দেরি করা চলবে না। সে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল–’আমি-আমি আলাদা শোব।’
দেবাশিসের মনে কৌতুকের সঙ্গে একটু বিস্ময় মিশল। কথাগুলো যেন একটু বেসুরো, ঠিক লজ্জার মত নয়। তবু সে হাসিমুখেই বলল—’তুমি আলাদা শুলে ফুলশয্যা হবে কি করে?
দীপার শরীর কেঁপে উঠল; সে শরীরের সমস্ত স্নায়ু পেশী শক্ত করে বলল–না–নাআমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। আমি-?
এবার দেবাশিসের মন থেকে কৌতুকের ভাব একেবারে লুপ্ত হয়ে গেল। সে কিছুক্ষণ স্থির চোখে দীপার। পানে চেয়ে থেকে বলল–’কি কথা বলতে চাও?’
দীপার ঘন ঘন নিশ্বাস পড়তে লাগল, সে কোনোমতে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–’আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, আমি অন্য একজনকে ভালবাসি।’
কথাটার ভাবাৰ্থ দেবাশিসের মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে বেশ খানিকক্ষণ সময় লাগল, তারপর তার মনে যে দীপ জ্বলেছিল, তা আস্তে আস্তে নিবে গেল; তার মনে হল, ঘরের উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোটাও যেন কমে কমে পিদিমির চেয়েও নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। সে দীপার। পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শুষ্ক প্রশ্ন করল—’তবে আমাকে বিয়ে করলে কেন?’
দীপা ঘাড় গুজে বসে রইল, কেবল তার অন্তরের ব্যাকুলত কণ্ঠস্বরে ব্যক্ত হ’ল–’আমি দোষ করেছি, কিন্তু আমার উপায় ছিল না। বাড়ির লোক জোর করে আমার বিয়ে দিয়েছে।’
‘যাকে ভালবাস তাকে বিয়ে করলেই পারতে।’
‘জাত আলাদা, তাই–’
‘জাত।’ একটা কঠিন হাসি দেবাশিসের মনের মধ্যে হিল্লোলিত হয়ে স্থির হল–’তা এখন কি করা যেতে পারে?’
দীপা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে ব্যগ্র মিনতির কণ্ঠে বলল–’আমাকে আপনার বাড়িতে থাকতে দিন, আমি আপনাকে বিরক্ত করব না, আপনার সামনে আসব না—‘তার গলা কান্নায় বুজে এল।
ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলে দেবাশিস নিজের চুলের মধ্যে আঙুল চালাল, বলল–’এর জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না। সব কথা ভেবে দেখতে হবে। তুমি যাও, শোও গিয়ে।’ সে ফুল দিয়ে সাজানো শয়নঘরের দিকে আঙুল দেখোল–’আমি অন্য কোথাও শোব।’
দীপা আর দাঁড়াল না, দ্রুত ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। তার চুলে তখনো ফুলের মালা জড়ানো, গলায় হাতে ফুলের গয়না। সেই অবস্থাতেই সে ফুল-ঢাকা বিছানার ওপর আছড়ে পড়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। এত সহজে পরিত্ৰাণ পাবে তা সে আশা করেনি।
দোতলায় আর একটি শয়নকক্ষ ছিল, দেবাশিসের বাবা যে ঘরে শুতেন; নকুল সে ঘরও পরিষ্কার করেছিল, খাটের ওপর বিছানা পেতে সুজনি ঢাকা দিয়ে রেখেছিল। বিয়ের শুভদিনে বাড়িতে কোথাও সে অপরিচ্ছন্নতা রাখেনি। দেবাশিস দীর্ঘকাল অব্যবহৃত এই ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ খাটের পাশে বসে রইল। মাথাটা গরম হয়ে উঠেছে, সে কক্ষসংলগ্ন বাথরুমে গিয়ে কল খুলে মাথাটা কলের তলায় রাখল। তারপর ভিজে মাথায় ফিরে এসে আলো নিভিয়ে বিছানার সুজনির ওপরেই শুয়ে পড়ল।
রেল গাড়ি প্রচণ্ড বেগে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ যখন লাইনের বাইরে লাফিয়ে পড়ে তখন কাউকে নোটিস দেয় না; দেবাশিসের জীবনে তেমনি আজ এই মহাদুর্যোগ এসেছে অপ্রত্যাশিতভাবে; দু’ মিনিট আগেও এই দুযোগের কোনো আভাস সে পায়নি। কিন্তু আত্মহারা হয়ে বিপথে কুপথে ছুটোছুটি করলে চলবে না, মাথা ঠাণ্ডা রেখে ভেবে-চিন্তে সুবুদ্ধির পথ বেছে নিতে হবে।
দেবাশিস জটিল চিন্তার মধ্যে ডুবে গেল। সে শান্ত ধীর প্রকৃতির মানুষ, অন্য কেউ হলে আজ রাত্রেই একটা কাণ্ড করে বসত।
দীপা অন্য একজনকে ভালবাসে, এইটেই হচ্ছে মূল কথা। দীপা কাকে ভালবাসে, সে লোকটা কে, তা জানিবার আগ্রহ দেবাশিসের নেই; সে যেই হোক না কেন, দীপা তাকে ভালবাসে। তবু দীপা পারিবারিক চাপে পড়ে দেবাশিসকে বিয়ে করেছে। কিন্তু এই বিয়েকে সে স্বামী-স্ত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্কে পরিণত করতে চায় না। . প্ৰেমাস্পদের সঙ্গে দীপার ঘনিষ্ঠতা কত দূর অগ্রসর হয়েছিল? জল্পনা নিষ্ফল।