দীপার বাড়ির সকলেই অবশ্য দীপার অসবৰ্ণ প্রণয়ের কথা জানে, বিজয়মাধব জানে। জেনে-শুিনে তারা এই কাজ করেছে। হয়তো ভেবেছে, বিয়ের পর দীপা ক্রমে তার প্রণয়ীকে ভুলে যাবে। কিন্তু দীপা ভুলবে বলে মনে হয় না, প্রণয়ীর প্রতি তার একনিষ্ঠা আছে। …নৃপতি কি জানে? বোধ হয় জানে না, জানলে দেবাশিসের এমন অনিষ্ট করত না; নৃপতিকে সজ্জন বলেই মনে হয়। …কিন্তু যা হবার তা তো হয়েছে, এখন এই জট ছাড়াবার উপায় কি? ডিভোর্স? একটা বেজে গেল, দুটো বেজে গেল। এতক্ষণ পরে দেবাশিস লক্ষ্য করল, বসবার ঘরে তীব্র শক্তির আলোটা জ্বলেই চলেছে। সে উঠে আলোটা নেবাতে গেল। দীপার ঘরের দরজা বন্ধ; দরজার পাশ দিয়ে যাবার সময় সে একটু থেমে কান পেতে শুনল, কিন্তু ঘরের ভিতর থেকে কোনো শব্দ এল না; দীপা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। সে বসবার ঘরের আলো নিবিয়ে ফিরে এসে আবার শুয়ে পড়ল।
ঝাঁ ঝাঁ রাত্রি। কলকাতা শহর নিঝুম হয়ে আছে। দূরে একটা রেলের ইঞ্জিন একটানা বাঁশী বাজাতে বাজাতে আরো দূরে গিয়ে মিলিয়ে গেল। দেবাশিস অন্ধকারে চোখ মেলে শুধু ভাবছে–
তিনটে বেজে গেল। দেবাশিসের মনে হল, নীরন্ধ অন্ধকারের মধ্যে এক বিন্দু জোনাকি আলো জ্বলছে আর নিবছে.একটা অর্ধ-পরিণত সংকল্প.তার বেশি আজ রাত্রে আর কিছু সম্ভব নয়…
দেবাশিস আবার বাথরুমে গিয়ে মাথায় জল ঢালল, তারপর ফিরে এসে বিছানায় শোবার। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।
কিন্তু বেশিক্ষণ ঘুমোতে পারল না, শরীরের ক্লান্তি কেটে যাবার পর ভোরের আলো ফুটতে-নো-ফুটতেই তার ঘুম ভেঙে গেল। সে মুখ ধুয়ে নীচে নেমে গেল। নকুল তখনো ওঠেনি, কাল রাত্রের খাটাখাটুনির পর আজ বোধ হয় একটু বেশি ঘুমিয়ে পড়েছে। দেবাশিস নিঃশব্দে সদর দরজা খুলে খোলা জায়গায় বেরিয়ে এল। শুকনো বাগানে ফুল নেই, কিন্তু ভোরের বাতাসটি বেশ মিঠে। সে সদর দরজা থেকে ফটক পর্যন্ত পায়চারি করতে লাগল।
একটু একটু করে দিনের আলো ফুটছে, কিন্তু এ রাস্তায় এখনো লোক চলাচল আরম্ভ হয়নি। দেবাশিস পায়চারি করতে করতে এক সময় ফটকের কাছে এসে দাঁড়াল। বন্ধ ফটকের উপর কনুই রেখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখল, বাঁ দিক থেকে একজন লোক হন।হন করে আসছে। কাছে এলে সে চিনতে পারল-বিজয়মাধব।
বিজয়মাধবের সঙ্গে এই কয় দিনে দেবাশিসের বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল, উপরন্তু সে এখন তার শ্যালক। কিন্তু বিজয়কে আসতে দেখে তার মনটা গরম হয়ে উঠল। তাই বিজয় যখন মুখে হাসি ফুটিয়ে ফটকের ওপারে এসে দাঁড়াল তখন দেবাশিসের মুখে সে হাসির প্রতিবিম্ব পড়ল না, সে গম্ভীর চোখে বিজয়ের পানে চেয়ে বলল–’আবার কি জন্যে এসেছেন? কৰ্তব্যকর্ম কি এখনো শেষ হয়নি?’
বিজয়ের হাসি মিলিয়ে গেল, সে থতমত খেয়ে বলে উঠল—’দীপা কিছু বলেছে নাকি?’
দেবাশিস নীরস কণ্ঠে বল–’সবই বলেছে। সে অন্তত আমায় ঠকায়নি।’
বিজয় কিছুক্ষণ হতবুদ্ধির মত চেয়ে থেকে হঠাৎ ফাটক খুলে ভিতরে এল, তারপর দেবাশিসের হাত চেপে ধরে ব্যগ্র মিনতির স্বরে বলল–’ভাই দেবাশিস, তুমি দীপার স্বামী, তুমি আমার পরমাত্মীয়, আমার ছোট ভাইয়ের সমান। আমি একটা কথা বলব, শুনবে?’
‘কি বলবেন বলুন।’
‘দীপা একেবারে ছেলেমানুষ, সবে সতেরো পেরিয়ে আঠারোয় পা দিয়েছে, ওর মনে কল্পনা-বিলাস ছাড়া আর কিছু নেই। ওইটুকু মেয়ের বুদ্ধিই বা কতখানি? তুমি ভাই ওর কথায় কান দিও না। দুচার দিন ঘর করলেই আগের কথা সব ভুলে যাবে। কম বয়সের একটা খেয়াল বই তো নয়?’
‘ওর কথা শুনে তা তো মনে হয় না।’
‘মেয়েমানুষের কথার কি কোনো দাম আছে? ওরা আধুনিক কায়দায় বড় বড় কথা বলে, ভিতরে কিন্তু ফঙ্কিকার। দীপা স্কুলে পড়েছে, স্কুলের মেয়েদের সঙ্গে মিশে পাকামি শিখেছে। ওর মনটা ভাবপ্রবণ; সিনেমা-থিয়েটার নাচগানের দিকে টান আছে, যদিও আমরা তাকে কোনোদিন আশকার দিইনি। আমি জোর গলায় বলছি, আমাদের বংশের মেয়ে কখনো বিপথে কুপথে যাবে না।’
দেবাশিস শান্ত গলায় বলল–’আপনার ভয় নেই, এ নিয়ে আমি ঝোঁকের মাথায় কোনো কেলেঙ্কারি কাণ্ড করব না, যা করবার ভেবে-চিন্তে করব। এ কথা বাড়ির বাইরে আর কেউ জানে?’
‘না।’ বিজয় আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় বাড়ির দোরের কাছে নকুলকে দেখা গেল। নকুল এগিয়ে এসে বলল-‘দাদাবাবু্, চা তৈরি হয়েছে।’
বিজয় খাটো গলায় তাড়াতাড়ি বলল—’আচ্ছা ভাই, আজ আমি যাই। শীগগির আবার আসব।’ বলে সে দ্রুতপদে চলে গেল।
দেবাশিস বাড়ির দিকে ফিরে যেতে যেতে বলল–’নকুল, তুই আমাদের চা ওপরের ঘরে দিয়ে আয়।’
নকুল মুচকি হেসে বলল—’তাই দিয়েছি দাদাবাবু!’ দেবাশিস দোতলায় উঠে গেল। দেখল, বসবার ঘরে নীচু টেবিলের ওপর চায়ের সরঞ্জাম সাজানো রয়েছে আর দীপা তক্তপোশের পাশে চুপটি করে বসে আছে—কাল রাত্রে যেমন বসে ছিল। অবশ্য কাল রাত্রের বাসি জামাকাপড়, ফুলের গয়না আর নেই, তার বদলে পাট-ভাঙ্গা শাড়ি ব্লাউজ। দেবাশিস আসতেই দীপা একটু আড়ষ্টভাবে উঠে দাঁড়াল।
দেবাশিস দোর বন্ধ করে দিয়ে দোরের সামনে ফিরে দাঁড়িয়ে দীপার। পানে তাকাল। খোলা জানালা দিয়ে সকালের নরম আলো দীপার ওপর পড়েছে। বিজয় যা বলেছিল তা মিথ্যে নয়, দীপার ছিপছিপে শরীরে কীেমার্যের কোমলতা এখনো লেগে আছে, ভারি ছেলেমানুষ মনে হয়। কিন্তু তার মুখে পরিণত মনের দৃঢ়তা, মুখের লাবণ্য যেন দৃঢ়তার উপাদানে তৈরি।
দেবাশিস কাছে এসে চায়ের সরঞ্জামের দিকে দৃষ্টি নামালো; টি-পটে চা, দু’টি পেয়ালা, গরম দুধ, চিনির কিউব, প্লেটে স্তুপীকৃত টোস্ট, মাখনের পাত্রে মাখন, অন্য একটি পাত্রে মারমালেড় এবং চারটি সিদ্ধ ডিম। নকুল দু’জনের জন্য প্রচুর প্রাতরাশ করেছে, একলা দেবাশিসের জন্য এত করে না।