শজারুর কাঁটা

দেবাশিস দীপার দিকে চোখ তুলে সহজ গলায় বলল–’তুমি চা ঢালবে?’

দীপাদের বাড়িতে সাবেক রেওয়াজ‌, পেয়ালায় চা ঢালা হয়ে সকলের কাছে যায়; প্রাতরাশ খাওয়ার কোনো বিধিবদ্ধ রীতি নেই। সে একটু ইতস্তত করল। তাই দেখে দেবাশিস বলল–’আচ্ছা‌, আমিই চা ঢালছি।’

দু’টি পেয়ালায় চা ঢেলে সে একটি পেয়ালা দীপার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল—’বসো। তোমার সঙ্গে কথা আছে‌, চা খেতে খেতে কথা হবে।’

দীপা সঙ্কুচিতভাবে চেয়ারে বসল। তার সঙ্কোচ মনের জড়ত্র নয়‌, অপরিচিত এবং অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সঙ্কোচ। তার জীবনে অভাবনীয় ওলট-পালট আরম্ভ হয়েছে।

দেবাশিস নিজের চায়ে একটি ছোট চুমুক দিয়ে পেয়ালা নামিয়ে রাখল‌, বলল–’তোমার দাদা বিজয়মাধব আজ ভোর হতে না হতে এসেছিল।’

দীপা চকিত চোখ তুলে আবার চোখ নত করল। দেবাশিস এক টুকরো টোস্টে মাখন লাগাতে লাগাতে বলল–’তার কথা শুনে মনে হল তোমার গুপ্তকথা বাড়ির সবাই জানে। বাইরের কেউ জানে নাকি?’

দীপা মাথায় একটা ঝাঁকনি দিয়ে বলল-‘না-না–।’ আর কোনো কথা তার শুকনো গলা দিয়ে বেরুল না।

দেবাশিস বলল–’তা সে যাই হোক‌, সব কথা বিবেচনা করা দরকার। একটা ব্যাপার ঘটেছে‌, আমার জীবনে হঠাৎ একটা বেয়াড়া সমস্যা এসে হাজির হয়েছে। যথাসাধ্য কেলেঙ্কারি বাঁচিয়ে তার নিম্পত্তি করতে হবে। আমার কথা বুঝতে পারছ?’

দীপা ঘাড় নাড়ল‌, অস্ফুট স্বরে বলল–’পারছি।’ সে কিন্তু দেবাশিসের ধরনধারন কিছুই বুঝতে পারছে না। এরকম অবস্থায় মানুষ কি এমনিভাবে কথা বলে?

দেবাশিস টেস্টে কামড় দিয়ে বলল–’তোমার চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।’

দীপা তাড়াতাড়ি চায়ের পেয়ালা হাতে তুলে নিল‌, কিন্তু হাতের পেয়ালা হাতেই রইল‌, ঠোঁট পর্যন্ত উঠল না।

দেবাশিস শান্তভাবে বলল—’সমস্যার সোজাসুজি নিষ্পত্তি আছে-ডিভোর্স।’

দীপার হাতের পেয়ালা কেঁপে উঠল। আর একটু হলেই পড়ে যেত। সে সামলে নিয়ে রুদ্ধস্বরে বলল—’না।’

দেবাশিস ভুরু তুলে বলল–’না কেন? তোমার বাড়ির লোক ভালবাসার পাত্রের সঙ্গে তোমার বিয়ে না দিয়ে অন্যায় করেছেন‌, সে অন্যায় সংশোধন করা উচিত।’

দীপা নত চোখে বলল—’আমার দাদু-তিনি তাহলে বাঁচবেন না।’

দেবাশিস কিছুক্ষণ কথা কইল না‌, কতকটা যেন অন্যমনস্কভাবে দীপার পানে চেয়ে রইল। তারপর নিজের ঈষদুষ্ণ পেয়ালাটা তুলে নিয়ে এক চুমুকে নিঃশেষ করে আবার রেখে দিল।

উদয়মাধবকে দেবাশিস দেখেছে, বৃদ্ধের চারিত্রিক প্রবলতা অনুভব করেছে, নাতনী ডিভোর্স-কোর্টে গিয়েছে শুনলে তিনি হয়তো আত্মহত্যা করবেন না‌, কিন্তু নাতনীকে খুন করতে পারেন।

‘ডিভোর্স যদি সম্ভব না হয় তাহলে দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে—তুমি বাপের বাড়ি ফিরে যাও‌, সেখানে যেমন ছিলে তেমনি থাকে।’

‘না‌, ওরা আবার আমায় ফেরত পাঠিয়ে দেবে। মাঝ থেকে জানাজানি হবে।’‌

‘তাহলে তৃতীয় পন্থা হচ্ছে এখানেই থাকা। আলাদাই থাকবে‌, আমি তোমার কাছে যাব না। কিন্তু আমারও তো লোকলজ্জা আছে। বাইরের লোকের কাছে ভণ্ডামি করতে হবে। তুমি পারবে?’

দীপা ঘাড় নেড়ে জানাল‌, সে পারবে।

দেবাশিস বলল–’বাড়ির চাকরীও বাইরের লোক। তার সামনেও ধোঁকার টাটি খাড়া রাখতে হবে।’

দীপা আবার ঘাড় নেড়ে সায় দিল।

দেবাশিস নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল–’বেশ। কিন্তু এভাবে কত দিন চলবে?’

দীপা চুপ করে রইল‌, এ প্রশ্নের উত্তর সে নিজেই জানে না। দেবাশিস আস্তে আস্তে ঘর ছেড়ে চলে গেল। স্ত্রীজাতি সম্বন্ধে তার অভিজ্ঞতা খুবই অল্প; কিন্তু তার মনে হল‌, এরা বড় স্বার্থপর‌, নিজের স্বার্থই বোঝে‌, আর কারুর কথা ভাবে না।

কাল দেবাশিস ভেবেছিল‌, এখন দু’তিন দিন সে ফ্যাক্টরিতে যাবে না‌, সারা দিন বাড়িতে থেকে বউয়ের সঙ্গে ভাব করবে। কিন্তু সব ভণ্ডুল হয়ে গেল। সে খানিকক্ষণ বিমনাভাবে ঘুরে বেড়ালো‌, কাল রাত্রে যে বিছানায় শুয়েছিল সেটা ঝেড়েকুড়ে ঠিক করে রাখল‌, নকুল না। সন্দেহ করে যে‌, তারা আলাদা শুয়েছে। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে বলল–’নকুল‌, আমার খাবার তৈরি কর‌, আমি ন’টার সময় ফ্যাক্টরি যাব।’

স্নান করতে গিয়ে দেবাশিসের একটা কথা মনে এল। সে দেখল‌, দীপা তখনো বসবার ঘরে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে‌, সে তার কাছে গিয়ে বলল–’নকুলের চোখে যদি ধুলো দিতে হয় তাহলে তোমার ঘরের লাগোয়া বাথরুমে আমাকে স্নান করতে হবে। অন্য বাথরুমে আমার ভিজে কাপড় দেখলে নকুলের মনে সন্দেহ হবে। আমি তোমার বাথরুমে স্নান করতে পারি?

দীপার মনে হল দেবাশিস তাকে ব্যঙ্গ করছে। সে চোখ তুলে চাইল‌, কিন্তু দেবাশিসের মুখে ব্যঙ্গবিদ্রূপের চিহ্নমাত্র দেখতে পেল না। সে তখন একটু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।

দেবাশিস মানাহার করে ন’টার সময় কাজে চলে গেল।

অতঃপর সংসারের সব ভার পড়ল নকুলের ওপর। নতুন বউকে বাড়ির কাজকর্ম শেখাতে হবে‌, বউয়ের খাওয়া-দাওয়ার ওপর নজর রাখতে হবে। বাড়িতে দ্বিতীয় স্ত্রীলোক নেই; সাময়িকভাবে নকুল হয়ে উঠল বাড়ির গিন্নী।

দুপুরবেলা দীপকে ভাত খাইয়ে নকুল ওপরে পাঠিয়ে দিল‌, বলল–’যাও‌, একটু ঘুমিয়ে নাও গিয়ে।’

কিন্তু দীপার দিনের বেলা ঘুমোনো অভ্যোস নেই। সে ঘুরে ঘুরে ওপরতলাটা দেখতে লাগল।…এই ঘরে কাল রাত্রে দেবাশিস। শুয়েছিল…নকুল যেন জানতে না পারে‌, সে ওপরে আসবার আগেই রোজ বিছানা ঝেড়ে ঠিকঠাক করে রাখতে হবে.বাড়ির পাশের ব্যালকনি থেকে বাগানটা দেখা যায়। বাগানের ছিরি নেই‌, যেন কত কাল কেউ বাগানের দিকে তাকায়নি। দেবাশিসের বাগানের শখ নেই। দীপার খুব বাগানের শখ আছে। সে বাপের বাড়ির খোলা ছাদে টবের বাগান করেছিল।

50 Shares