শজারুর কাঁটা

ঘণ্টাখানেক ঘুরে ফিরে সে বসবার ঘরে এল। রেডিওগ্রামের ওপর নজর পড়ল। দীপা রেডিও শুনতে ভালবাসে. বাপের বাড়িতে তার একটি ট্রানজিস্টার ছিল‌, সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে গান শুনত‌, ফুটবলের কমেন্টারি শুনাত‌, নাট্যাভিনয় শুনত। ট্রানজিস্টারটা আনা হয়নি। তার অনেক নিজস্ব জিনিস বাপের বাড়িতে পড়ে আছে।

দীপা রেডিওগ্রামের কপাট সরিয়ে কলকব্জা নাড়াচাড়া করতে করতে গানের সুর বেজে উঠল। দুপুরবেলার শান্ত ত্ররাহীন প্রোগ্রাম। সে রেডিওর পাশে একটা গদি-মোড়া আরাম-চেয়ারে বসে শুনতে লাগল।

কাল রাত্রে দীপা অল্পই ঘুমিয়েছে‌, যেটুকু ঘুমিয়েছে তাও যেন আড়ষ্ট হয়ে। এখন রেডিওর মৃদু গুঞ্জন শুনতে শুনতে তার চোখ বুজে এল।

হঠাৎ তার চমক ভাঙল টেলিফোনের শব্দে। সে চোখ মেলে দেখল‌, ঘরের কোণে ছোট টেবিলের ওপর টেলিফোন বাজছে। দীপা রেডিও বন্ধ করে দিল। নিশ্চয় দেবাশিসের টেলিফোন। একটু ইতস্তত করে সে উঠে গিয়ে ফোন তুলে নিল।

‘হ্যালো।‘

অপর প্রান্ত থেকে আওয়াজ এল—’দীপা‌, আমার গলা চিনতে পারছ?’

দীপার বুক ধড়ফড় করে উঠল‌, সে অবরুদ্ধ স্বরে বলল–’পারছি।’

‘ঘরে কেউ আছে?’

না‌, আমি একা।’

‘বেশ। তোমার স্বামীকে বলেছ?’

‘বলেছি।’

‘তারপর?’

‘তারপর আর কিছু না।’

‘রাত্রে তোমাকে বিরক্ত করেনি?

‘না।‘

‘তুমি একলা শুয়েছিলে?’

‘হ্যাঁ।’

‘বেশ। এইভাবে চালিয়ে যাও।’

‘কত দিন?

‘একটু সময় লাগবে। তুমি ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। শপথ মনে আছে তো?’

‘হ্যাঁ।‘

‘শপথ করেছ‌, আমার নাম কাউকে বলবে না। মা কালীর নামে শপথ করেছ‌, মনে আছে?’

‘আছে।’

‘তোমার স্বামী হয়তো নাম জানবার জন্যে পীড়ন করতে পারে।’

‘নাম জানতে চাননি। চাইলেও আমি বলব না।’

‘বেশ। আমি মাঝে মাঝে তোমাকে ফোন করব। দুপুরবেলা তোমার স্বামী যখন বাড়িতে থাকবে না। তখন ফোন করব।’

‘আচ্ছা।’

সে ফোন রেখে দিয়ে আবার চেয়ারে এসে বসল। মনে হল তার শরীরের সমস্ত জোর ফুরিয়ে গেছে।

বিকেল পাঁচটার সময় দেবাশিস ফ্যাক্টরি থেকে ফিরে এল। নকুল দোর খুলে দিল। দীপা ওপর থেকে ঘন্টির আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল‌, সে উৎকৰ্ণ হয়ে রইল।

দেবাশিস ওপরে উঠে এসে দেখল‌, দীপা নীরব রেডিওগ্রামের সামনে বসে আছে। সে ঢুকতেই দীপা চকিতে একবার তার দিকে চেয়ে উঠে দাঁড়াল। দেবাশিস দ্বিধামন্থর পায়ে তার সামনে এল। কারুর মুখে কথা নেই। কিন্তু শুধু মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা কতক্ষণ চলে! শেষে দেবাশিস বলল—’নকুল তোমার দেখাশুনো করেছিল তো?’

দীপা ঘাড় নেড়ে বলল–’হ্যাঁ।’

দেবাশিস প্রশ্ন করল–’চা খেয়েছ?’

দীপা মাথা নাড়ল–’না।’

অতঃপর আর কি বলা যেতে পারে‌, দেবাশিস ভেবে পেল না। ওদিকে দীপা প্ৰাণপণে চেষ্টা করছে সহজভাবে যা হোক একটা কিছু বলতে। কিন্তু কী বলবে? বক্তব্য কী আছে? শেষ পর্যন্ত একটা কথা মনে এল‌, সে ঘাড় তুলে বলল—’আপনি দুপুরবেলা কোথায় খাওয়া-দাওয়া করেন?’

দেবাশিস বলল—’আমার ফ্যাক্টরিতে খাওয়ার ভাল ব্যবস্থা আছে। ফ্যাক্টরিতে যারা কাজ করে সকলেই দুপুরবেলা ক্যানটিনে খায়। আমিও খাই।’

দীপা শুধু বলল–’ও।’

দেবাশিস বলল–’আচ্ছা‌, আমি কাপড়-চোপড় বদলে নিই‌, তারপর নীচে গিয়ে চা খাওয়া যাবে।’

সংশয়স্খলিত স্বরে দীপা বলল–’আচ্ছা।’

দেবাশিস দীপার ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল–’আমি তাহলে তোমার বাথরুমেই ব্যবহার করছি।’

দোর পর্যন্ত গিয়ে দেবাশিস থমকে দাঁড়াল‌, তারপর আস্তে আস্তে দীপার সামনে ফিরে এসে গলা খাটো করে বলল—‘একটা কথা। তুমি আমাকে ‘আপনি বললে ভাল শোনায় না। অবশ্য আড়ালে তা বলতে পোর‌, কিন্তু নকুল কিংবা অন্য কারুর সামনে ‘তুমি বলাই স্বাভাবিক। নইলে ওদের খটকা লাগতে পারে।’

দীপা মুখ নীচু করে নীরব রইল।

দেবাশিস প্রশ্ন করল–’কি বলো?’

দীপা অনিচ্ছাভিরা ক্ষীণ স্বরে বলল–’আচ্ছা।’

দেবাশিস বাথরুমে চলে গেল। দীপা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল‌, প্রকাশ্যে ‘তুমি বলা এবং আড়ালে ‘আপনি বলা কি খুব সহজ কাজ? রঙ্গালয়ের নটনটীরা বোধহয় পারে। তার মনে হল সে আস্তে আস্তে অতলস্পর্শ চোরাবালির মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে।

দশ মিনিট পরে দেবাশিস পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে লাগাতে বেরিয়ে এল‌, বলল–’চল‌, নীচে যাই।’

দেবাশিসের পিছু পিছু দীপা নীচে নেমে গেল‌, দু’জনে টেবিলের দু’প্রান্তে বসল। নকুল তাদের সামনে রেকাবি-ভরা লুচি তরকারি রাখল। দেবাশিস খেতে আরম্ভ করল। কিন্তু দীপা হাত গুটিয়ে বসে রইল।

নকুল জিজ্ঞেস করল-‘দাদাবাবু্‌, ডিম ভেজে দেব?’

দেবাশিস দীপার পানে চাইল। দীপা একটু মাথা নাড়ল; বাপের বাড়িতে তার ডিম খাওয়া বারণ ছিল। আইবুড়ো মেয়েদের ডিম খেতে নেই।

দেবাশিস বলল–’থাক‌, দরকার নেই।’

চায়ের পেয়ালা টেবিলে রাখতে এসে নকুল বলল–’ও কি বউদি‌, তুমি খাচ্ছ না?’

দীপা মাথা হেঁট করল‌, তারপর কাতর দৃষ্টিতে দেবাশিসের পানে তাকাল। দেবাশিস বুঝতে পারল দীপার সংকোচের কারণ কি। সে একটু হেসে বলল—’নকুল‌, ওর বোধহয় পুরুষের সামনে খাওয়া অভ্যোস নেই।’

দেবাশিস তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ল। সে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর নকুল দীপার কাছে এসে বলল–’বউদি‌, এ সংসারে মেয়ে-পুরুষ সবাই একসঙ্গে খায়‌, কতর্বিাবুর আমল থেকে এই রেওয়াজ দেখে আসছি। তুমি যখন এ বাড়ির বউ হয়ে এসেছি তখন তোমাকেও তোক এ বাড়ির রেওয়াজ মেনে চলতে হবে। ভাবনা নেই‌, আস্তে আস্তে অভ্যোস হয়ে যাবে। নাও‌, খেতে আরম্ভ কর। তোমার বাপের বাড়িতে কি ডিমের চলন নেই?

50 Shares