দু’জনে নীচে নেমে গেল। রান্নাঘরের টেবিলেও গোলাপগুচ্ছ। দেবাশিস দীপার পানে প্রশংসাপূর্ণ চোখে চেয়ে একটু হাসল।
সে-রাত্রে নিজের ঘরে শুতে গিয়ে দেবাশিস দেখল, তার ড্রেসিং টেবিলের ওপরেও আলাপের ফেয়ার। দীপা তার ঘরে ফুল রাখতে ভোলেনি। দেবাশিসের মন মাধুৰ্যপূর্ণ হয়ে দীপা নিজের ঘরে গিয়ে নৈশদীপ জ্বেলে শুয়েছিল। কিন্তু ঘুম সহজে এল না। মনের মধ্যে একটি আলোর চারপাশে বাদলা পোকার মত অনেকগুলো ছোট ছোট চিস্তার টুকরো ঘুরে বেড়াচ্ছে। আলোটি স্নিগ্ধ তৃপ্তির আলো। আজকের দিনটা যেন গোলাপ-জলের ছড়া দিয়ে এসেছিল…ফ্যাক্টরিতে অনুষ্ঠান.ডক্টর দত্ত্্, সভামণ্ডপে গান…তোমরা সবাই ভাল…ফ্যাক্টরির সবাই যেন প্ৰাণপণে চেষ্টা করেছে তাকে খুশি করতে…রাশি রাশি গোলাপফুল…ঘরে সাজিয়ে রাখতে কী ভালই লাগে…দেবাশিসের ভাল লেগেছে.সে অমন মুখ টিপে হাসল কেন?…যেন হাসির আড়ালে কিছু মানে ছিল-ওঃ!
শুয়ে শুয়ে দীপার মুখ উত্তপ্ত হয়ে উঠল। সে মনের ভুলে দেবাশিসকে আড়ালে ‘তুমি বলে ফেলেছিল, তখন বুঝতে পারেনি। দেবাশিস তাই শুনে হেসেছিল।
দীপা বিছানা থেকে উঠে খোলা জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সামনে দিয়ে ডাইনে বাঁয়ে রাস্তা চলে গেছে; রাস্তার ওপারের তিন চারটে বাড়ির সদর এই জানলা থেকে দেখা যায়। বাড়িগুলির আলো নিবে গেছে। রাস্তায় দুসারি আলো নিষ্পলক জ্বলছে। রাস্তা দিয়ে দু’একটি লোক কদাচিৎ চলে যাচ্ছে, পঁচিশ গজ দূর থেকে তাদের জুতোর খট্খটু শব্দ শোনা যাচ্ছে। আধ-ঘুমন্ত রাত্রি।
ভণ্ডামি করা, মিথ্যে অভিনয় করে মানুষকে ঠকানো, এসব দীপার প্রকৃতিবিরুদ্ধ। তবু ঘটনাচক্রে সে দেবাশিসের সঙ্গে লোক ঠকানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। অবশ্য ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে খানিকটা মানসিক ঘনিষ্ঠতা অনিবার্য। সেজন্য দেবাশিসের কোনো দোষ নেই; সে স্বভাব-ভদ্রলোক, তার প্রকৃতি মধুর। কিন্তু সান্নিধ্য যতাই ঘনিষ্ঠ হোক, দীপা তাকে ভালবাসে না, অন্য একজনকে ভালবাসে। কতকগুলো অভাবনীয় ঘটনা-সমাবেশের ফলে দীপা আর দেবাশিস একত্র নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এ অবস্থায় দীপা যদি দেবাশিসের সঙ্গে সহজ সম্বন্ধে বাস করে তাতে দোষ কি? তাকে আড়ালে ‘তুমি বললে অন্যায় হবে কেন? কাউকে ‘তুমি বললেই কি তার সঙ্গে ভালবাসার সম্বন্ধ বোঝায়?
মনের অস্বস্তি অনেকটা কমলো। সে আবার গিয়ে বিছানায় শুল এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল। সে লক্ষ্য করেনি যে, যতক্ষণ সে জানলায় দাঁড়িয়ে ছিল ততক্ষণ একটি লোক রাস্তার ল্যাম্প-পোস্টে ঠেস দিয়ে একদৃষ্টি তার পানে তাকিয়ে ছিল। লক্ষ্য করলে এত সহজে ঘুম আসত না।
৫
পরদিন সকালবেলা ওপরের বসবার ঘরে চা খেতে খেতে দেবাশিস বলল–’তুমি সারাদিন একলা থাকে, সময় কাটে কি করে?
দীপা চুপ করে রইল। সময় কাটবার তাই কাটে, সময়ের যদি দাঁড়িয়ে পড়বার উপায় থাকত তাহলে বোধহয় দীপার সময় দাঁড়িয়েই পড়ত।
দেবাশিস বলল–’তোমার বই পড়ার শখ নেই; বাড়িতে কিছু বই আছে কিন্তু সেগুলো বিজ্ঞানের বই। তুমি যদি চাও বইয়ের দোকান থেকে গল্প-উপন্যাসের বই এনে দিতে পারি। মাসিক সাপ্তাহিক কাগজের গ্রাহক হওয়া যায়।’
দীপা এবারও চুপ করে রইল। বই পড়তে সে ভালবাসে, ভাল লেখকের ভাল গল্প-উপন্যাস পেলে পড়ে, কিন্তু বই মুখে দিয়ে তো সারা দিন-রাত কাটে না।
‘কিংবা তোমাকে বইয়ের দোকানে নিয়ে যেতে পারি, তুমি নিজের পছন্দ মত বই কিনো।’ দীপা সংশয় জড়িত স্বরে বলল–’আচ্ছা।’
দেবাশিস বুঝল, বই সম্বন্ধে দীপার বেশি আগ্রহ নেই। তখন সে বলল—’তোমার বান্ধবীদের বাড়িতে ডাকো না কেন? তাদের সঙ্গে গল্প করেও দুদণ্ড সময় কাটবে।’
দীপা বলল–’আচ্ছা, ডাকব।’
চা শেষ করে দেবাশিস জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নীচে অনাদৃত বাগানের পানে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ঘরের দিকে ফিরে বলল–’তুমি ফুল ভালবাস। বাগান করার শখ আছে কি?’
‘আছে।’ দীপা সাগ্রহে উঠে দাঁড়াল, এক পা এক পা করে দেবাশিসের কাছে এসে বলল-‘বাপের বাড়িতে ছাদের ওপর বাগান করেছিলুম, টবের বাগান।’
দেবাশিস হেসে বলল–’ব্যস, তবে আর কি, এখানে মাটিতে বাগান কর। বাবা মারা যাবার পর বাগানের যত্ন নেওয়া হয়নি। আমি আজই ব্যবস্থা করছি। আগে একটা মালী দরকার, তুমি একলা পারবে না।’
পরদিন মালী এল, গাড়ি গাড়ি সার এল, কোদাল খন্তা খুরপি গাছকটা কাঁচি এল, নাসরি থেকে মৌসুমী ফুলের বীজ, গোলাপের কলম, বারোমেসে গাছের চারা এল, ছোট ছোট সুপুরিগাছ এল। মহা আড়ম্বরে দীপার জীবনের উদ্যান পর্ব আরম্ভ হয়ে গেল।
তারপর কয়েকদিন প্রবল উত্তেজনার মধ্যে কাটল। প্রৌঢ় মালী পদ্মলোচন অতিশয় বিজ্ঞ ব্যক্তি, তার সঙ্গে পরামর্শ করে কোথায় মৌসুমী ফুলের বীজ পোঁতা হবে, কোথায় গোলাপের কলম বসবে, কীভাবে সুপুরি আর ঝাউ-এর সারি বসিয়ে বীথিপথ তৈরি হবে, দীপা তারই প্ল্যান করছে। ঘুমে জাগরণে বাগান ছাড়া তার অন্য চিস্তা নেই।
দেবাশিস নির্লিপ্তভাবে সব লক্ষ্য করে, কিন্তু দীপার কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করে না, এমন কি তাকে বাগান সম্বন্ধে পরামর্শ দিতেও যায় না। দীপা যা করছে। কারুক, তার যাতে মন ভাল থাকে। তাই ভাল।
দিন কাটছে।
একদিন দুপুরবেলা দীপা রেডিওর মৃদু গুঞ্জন শুনতে শুনতে ভাবছিল, আরোকোরিয়া পাইন-এর চারাটি বাগানের কোন জায়গায় বসালে ভাল হয়, এমন সময় ঘরের কোণে টেলিফোন বেজে উঠল। দীপা চকিতে সেই দিকে চাইল, তারপরে উঠে গিয়ে ফোন তুলে নিল—’হ্যালো।‘