শজারুর কাঁটা

টেলিফোনে আওয়াজ এল–’আমি। গলা চিনতে পারছ?’

দীপার বুকের মধ্যে দু’বার ধকধক করে উঠল। সে যেন ধাক্কা খেয়ে স্বপ্নলোক থেকে বাস্তব জগতে ফিরে এল। একটু দম নিয়ে একটু হাঁপিয়ে বলল—’হ্যাঁ।’

‘খবর সব ভাল?’

‘হাঁ।’

‘কোনো গোলমাল হয়নি?’

‘না।‘

‘তোমার স্বামী মানুষটা কেমন?

‘মন্দ মানুষ নয়।’

‘তোমার ওপর জোর-জুলুম করছে না?

‘না।‘

‘একেবারেই না?’

‘না।‘

‘হুঁ। আরো কিছুদিন এইভাবে চালাতে হবে।’

‘আর কত দিন?’

‘সময়ে জানতে পারবে। আচ্ছা।’

ফোন রেখে দিয়ে দীপা আবার আরাম-চেয়ারে এসে বসল‌, পিছনে মাথা হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইল। রেডিওর মৃদু গুঞ্জন চলছে। দুমিনিট আগে দীপা বাগানের কথা ভাবছিল‌, এখন মনে হল বাগানটা বহু দূরে চলে গেছে।

বিকেলবেলা আন্দাজ সাড়ে তিনটের সময় নীচে সদর দোরের ঘন্টি বেজে উঠল। দীপা চোখ খুলে উঠে বসল। কেউ এসেছে। দেবাশিস কি আজ তাড়াতাড়ি ফিরে এল? কিন্তু আজ তো শনিবার নয়–

দীপা উঠে গিয়ে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়াল। নকুল দোর খুলছে। তারপরই মেয়েলি গলা শোনা গেল—’আমি দীপার বন্ধু, সে বাড়িতে আছে তো?

নকুল উত্তর দেবার আগেই দীপা ওপর থেকে ডাকল–’শুভ্রা, আয়‌, ওপরে চলে আয়।’

শুভ্ৰা ওপরে এসে সিঁড়ির মাথায় দীপকে জড়িয়ে ধরল‌, বলল—’সেই ফুলশয্যের রাত্রে তোকে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছিলুম। তারপর আসিনি‌, তোকে হনিমুন করবার সময় দিলুম। আজ ভাবলুম‌, দীপা আর কনে-বাউ নেই‌, এত দিনে পাকা গিনী হয়েছে‌, যাই দেখে আসি। হ্যাঁ ভাই‌, তোর বর বাড়িতে নেই তো?’

‘না। আয়‌, ঘরে আয়।’

শুভ্রা মেয়েটি দীপার চেয়ে বছর দেড়েকের বড়‌, বছরখানেক আগে বিয়ে হয়েছে। তার চেহারা গোলগাল‌, প্রকৃতি রঙ্গপ্রিয়‌, গান গাইতে পারে। প্রকৃতি বিপরীত বলেই হয়তো দীপার সঙ্গে তার মনের সান্নিধ্য বেশি।

বসবার ঘরে গিয়ে তারা পশ্চিমের খোলা জানলার সামনে দাঁড়াল। শুভ্ৰা দীপাকে ভাল করে দেখে নিয়ে মৃদু হাসল‌, বলল—‘বিয়ের জল গায়ে লাগেনি‌, বিয়ের আগে যেমন ছিলি এখনো তেমনি আছিস। কিন্তু গায়ে গয়না নেই কেন? হাতে দু’গাছি চুড়ি‌, কানে ফুল আর গলায় সরু হার; কনে-বউকে কি এতে মানায়।’

দীপা চোখ নামাল‌, তারপর আবার চোখ তুলে বলল—’তুই তো এখনই বললি আমি আর কনে-বউ নই।’

শুভ্ৰা বলল–’গয়না পরার জন্য তুই এখনও কনে-বাউ। কিন্তু আসল কথাটা কী? ‘আভরণ সৌতিনি মান’?’

‘সে আবার কি?’

‘তা জানিস না! কবি গোবিন্দদাস বলেছেন‌, সময়বিশেষে গয়না সতীন হয়ে দাঁড়ায়।’ এই বলে দীপার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে গাইল–

‘সখি‌, কি ফল বেশ বনান

কানু পরশমণি পরাশক বাধন

আভরণ সৌতিনি মান।’

দীপার মুখের ওপর যেন এক মুঠো আবির ছড়িয়ে পড়ল। সে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল–’যাঃ‌, তুই বড় ফাজিল।’

শুভ্ৰা খিলখিল করে হেসে বলল—’তুইও এবার ফাজিল হয়ে যাবি‌, আর গাম্ভীৰ্য চলবে না। বিয়ে হলেই মেয়েরা ফাজিল হয়ে যায়।’

দীপা কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না। কিন্তু যেমন করে হোক সত্যি কথা লুকিয়ে রাখতে হবে‌, মিথ্যে কথা বলে শুভ্রার চোখে ধুলো দিতে হবে। শুভ্রা যেন জানতে না পারে।

দীপা আকাশ-পাতাল ভাবছে শুভ্রার ঠাট্টার কি উত্তর দেবে‌, এমন সময় দোরের কাছে থেকে নকুলের গলা এল—’বউদি‌, চা জলখাবার আনি?’

দীপা যেন বেঁচে গেল। বলল—’হ্যাঁ নকুল‌, নিয়ে এস।’

নকুল নেমে গেল। দীপা বলল—’আয় ভাই‌, বসি। তারপর হিমানী সুপ্রিয়া কেমন আছে বল। মনে হচ্ছে যেন কতদিন তাদের দেখিনি!’

শুভ্ৰা চেয়ারে বসে বলল—’হিমানী সুপ্রিয়ার কথা পরে বলব‌, আগে তুই নিজের কথা বল। বরের সঙ্গে কেমন ভাব হল?’

দীপা ঘাড় হেঁট করে অর্ধস্ফুট স্বরে বলল–’ভাল।’

শুভ্রা বলল—’তোর বরটি ভাই দেখতে বেশ। কিন্তু দেখতে ভাল হলেই মানুষ ভাল হয় না। মানুষটি কেমন?’

দীপাবলল–’ভাল।’

শুভ্ৰা বিরক্ত হয়ে বলল–’ভাল আর ভাল‌, কেবল এক কথা! তুই কি কোনো দিন মন খুলে কিছু বলবি না?’

‘বললুম তো‌, আর কি বলব?’

‘এইটুকু বললেই বলা হল? আমার যখন বিয়ে হয়েছিল। আমি ছুটে ছুটে আসতুম তোর কাছে‌, সব কথা না বললে প্রাণ ঠাণ্ডা হত না। আর তুই মুখ সেলাই করে বসে আছিস। গা জ্বলে যায়।’

দীপা তার হাত ধরে মিনতির স্বরে বলল–’রাগ করিাসনি ভাই! জানিস তো‌, আমি কথা বলতে গেলেই গলায় কথা আটকে যায়। মনে মনে বুঝে নে না। সবই তো জানিস।’

শুভ্রা বলল—’সবায়ের কি এক রকম হয়? তাই জানতে ইচ্ছে করে। যাক গে‌, তুই যখন বলবি না। তখন মনে মনেই বুঝে নেব। আচ্ছা‌, আজ উঠি‌, তোর বিয়ে পুরনো হোক তখন আবার একদিন আসব।’

দীপা কিন্তু শক্ত করে তার হাত ধরে রইল‌, বলল–’না‌, তুই রাগ করে চলে যেতে পাবি না।’

শুভ্রার রাগ অমনি পড়ে গেল‌, সে হেসে বলল–’তুই হদ্দ করলি। বরের কাছেও যদি এমনি মুখ বুজে থাকিস বর ভুল বুঝবে। ওরা ভুল-বোঝা মানুষ।’

নকল চায়ের ট্রে নিয়ে এল‌, সঙ্গে স্তুপাকৃতি প্যাসট্রি। দীপা চা ঢেলে শুভ্রাকে দিল‌, নিজে নিল; দু’জনে চা আর প্যাসট্রি খেতে খেতে সাধারণভাবে গল্প করতে লাগল। শাড়ি ব্লাউজ‌, গয়নার নতুন ফ্যাশন‌, সেন্ট স্নো পাউডার-এর দুমূল্যতা‌, এই সব নিয়ে গল্প। শুভ্ৰাই বেশি কথা বলল‌, দীপা সায় উত্তর দিল।

আধা ঘণ্টা পরে চা খাওয়া শেষ হলে নকুল এসে ট্রে তুলে নিয়ে গেল‌, দীপা তখন বলল–’শুভ্রা, তুই এবার একটা গান গা‌, অনেক দিন তোর গান শুনিনি।’

শুভ্রা বলল—’কেন‌, এই তো কানে কানে গান শুনলি। আর কী শুনিবি? মম যৌবননিকুঞ্জে গাহে পাখি‌, সখি জাগো?

‘না না‌, ওসব নয়। আধুনিক গান।’

‘আধুনিক গানের কথায় মনে পড়ল‌, পরশু গ্রামোফোনের দোকানে গিয়েছিলুম‌, প্রবাল গুপ্তর একটা নতুন রেকর্ড শুনলাম। ভারি সুন্দর গেয়েছে। রেকর্ডখানা কিনেছি। তুই শুনেছিস?

50 Shares