শজারুর কাঁটা

দীপা অলসভাবে বলল–’শুনেছি। রেডিওতে প্রায়ই বাজায়। সিনেমার গানের কোনো নতুন রেকর্ড বেরিয়েছে নাকি?’

শুভ্রা বলল—’শুনিনি। কিন্তু একটা নতুন ছবি বেরিয়েছে‌, ‘দীপ্তি’ সিনেমায় দেখাচ্ছে; ছবিটা নাকি খুব ভাল হয়েছে। সুজন হিরো‌, জোনাকি রায় হিরোইন।’

দীপা একটু নড়েচড়ে বসল‌, কিছু বলল না। শুভ্রা বলল–’দীপা‌, ঘরে বসে কি করবি‌, চল ছবি দেখে আসি। আমার সঙ্গে যদি ছবি দেখতে যাস‌, তোর বর নিশ্চয় রাগ করবে না।’ কব্জির ঘড়ি দেখে বলল—’সওয়া চারটে বেজেছে। তোর বির কাজ থেকে ফেরে। কখন?’

‘পাঁচটার সময়।’

‘তবে তো ঠিকই হয়েছে। তুই সেজেগুজে তৈরি হতে হতে তোর বর এসে পড়বে‌, তখন তাকে জানিয়ে আমরা ছবি দেখতে চলে যাব। আর তোর বর। যদি সঙ্গে যেতে চায় তাহলে তো আরো ভাল।’

দীপার ইচ্ছে হল শুভ্রার সঙ্গে ছবি দেখতে যায়। দেবাশিস কোনো আপত্তি তুলবে না। তাও সে জানে। তবু তার মনের একটা অংশ তার ইচ্ছাকে পিছন থেকে টেনে ধরে রইল‌, তাকে যেতে দেবে না। সে কাচুমাচু হয়ে বলল–’আজ থাক ভাই‌, আর একদিন যাব।’

শুভ্ৰা আরো কিছুক্ষণ পীড়াপীড়ি করল‌, কিন্তু দীপা রাজী হল না। শুভ্রা তখন বলল—’বুঝেছি‌, তুই বর-হাংলা হয়েছিস‌, বরকে ছেড়ে নড়তে পারিস না। বিয়ের পর কিছু দিন আমারও হয়েছিল।’ সে নিজের বর-হ্যাংলামির গল্প বলতে লাগল। তারপর হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল–’পাঁচটা বাজে‌, আমি পালাই‌, এখনই তোর বর এসে পড়বে। আমি থাকলে তোদের অসুবিধে হবে। আবার একদিন আসব।’ শুভ্ব হাসতে হাসতে চলে গেল।

তাকে সদর দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে দীপা ভাবতে লাগল‌, কি আশ্চর্য মনের কথা মুখ ফুটে না বললে কি কেউ বুঝতে পারে না! সবাই ভাবে‌, যা গতানুগতিক তাই সত্যি!

তারপর দিন কাটছে।

একদিন বেশ গরম পড়েছে। গুমোট গরম‌, বাতাস নেই; তাই মনে হয়। শীগগিরই ঝড়-বৃষ্টি নামবে। দেবাশিস বিকেলবেলা ফ্যাক্টরি থেকে ফিরে এসে দেখল‌, দীপা আর পদ্মলোচন দড়ি ধরে বাগান মাপজোক করছে। দেবাশিসকে দেখে দীপা দড়ি ফেলে তাড়াতাড়ি তার গাড়ির কাছে এল‌, বেশ উত্তেজিতভাবে বলল–’ঈস্টার লিলিতে কুঁড়ি ধরেছে। দেখবে?

দেবাশিস গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বলল–’তাই নাকি! কোথায় ঈস্টার লিলি?’

‘এস‌, দেখাচ্ছি।’

বাগানের এক ধারে দীপা আঙুল দেখাল। দেবাশিস দেখল‌, ভূমিলগ্ন ঝাড়ের মাঝখান থেকে ধ্বজার মত ডাঁটি বেরিয়েছে‌, তার মাথায় তিন-চারটি কুঁড়ির পতাকা। স্নিগ্ধ হেসে দেবাশিস দীপর পানে চাইল–’তোমার বাগানের প্রথম ফুল।’

হাসতে গিয়ে দীপা থেমে গেল। ‘তোমার বাগানের–’‌, বাগান কি দীপার? হঠাৎ তার মনটা বিকল হয়ে গেল‌, প্রথম মুকুলোদগম দেখে যে আনন্দ হয়েছিল তা নিবে গেল।

সন্ধ্যের পর নৃপতির আড্ডায় গিয়ে দেবাশিস দেখল আড্ডাধারীরা প্ৰায় সকলেই উপস্থিত‌, বেশ উত্তেজিতভাবে আলোচনা চলছে। তাকে দেখে সকলে কলরব করে উঠল–’ওহে‌, শুনেছি?’

সুজন থিয়েটারী পোজ দিয়ে বলল–’আবার শজারুর কাঁটা।’

নৃপতি বলল–’এস‌, বলছি। তুমি কাগজ পড় না‌, তাই জান না। মাসখানেক আগে একটা ভিখিরিকে কেউ শজারুর কাঁটা ফুটিয়ে মেরেছিল মনে আছে?

দেবাশিস বলল—’হ্যাঁ‌, মনে আছে।’

‘পরশু রাত্রে একটা মজুর লেকের ধারে বেঞ্চিতে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল‌, তার হৃদযন্ত্রে শজারুর কাঁটা ঢুকিয়ে দিয়ে কেউ তাকে খুন করেছে।’

দেবাশিস বলল–’কে খুন করেছে‌, জানা যায়নি?’

নৃপতি একটু হেসে বলল–’না‌, পুলিস তদন্ত করছে।’

কপিল বলল—’পুলিস অনন্তকাল ধরে তদন্ত করলেও আসামী ধরা পড়বে না। অবশ্য স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে‌, ভিখিরি এবং মজুরের হত্যাকারী একই লোক। এ ছাড়া আর কেউ কিছু বুঝতে পেরেছ কি?’

খড়্গ বাহাদুর বলল—’দুটো খুনই আমাদের পাড়ায় হয়েছে‌, সুতরাং অনুমান করা যেতে পারে। যে হত্যাকারী আমাদের পাড়ার লোক।’

নৃপতি বলল–’তা নাও হতে পারে। হত্যাকারী হয়তো টালার লোক।’

এই সময় কফি এল। প্রবাল এতক্ষণ পিয়ানোর সামনে মুখ গোমড়া করে বসে ছিল‌, আলোচনার হল্লায় বাজাতে পারছিল না; এখন উঠে এসে এক পেয়ালা কফি তুলে নিল। কপিল তাকে প্রশ্ন করল–’কি হে মিঞা তানসেন‌, তোমার কি মনে হয়?’

প্রবাল কফির পেয়ালায় একবার ঠোঁট ঠেকিয়ে বলল–’আমার মনে হয় হত্যাকারী উম্মাদ এবং তোমরাও বদ্ধ পাগল!’

সবাই হইচই করে উঠল–’আমরা পাগল কেন?’

প্রবাল বলল—’তোমরা হয় পাগল নয়। ভণ্ড। একটা কুলিকে যদি কেউ খুন করে থাকে তোমাদের এত মাথাব্যথা কিসের? কুলির শোকে তোমাদের বুক ফেটে যাচ্ছে এই কথা বোঝাতে চাও?՚

অতঃপর তর্ক উদাম এবং উত্তাল হয়ে উঠল।

দেবাশিস তর্কাতর্কি বাগযুদ্ধ ভালবাসে না। সে কফি শেষ করে চুপিচুপি পালাবার চেষ্টায় ছিল‌, নৃপতি তা লক্ষ্য করে বলল–’কি হে দেবাশিস‌, চললে নাকি?’

দেবাশিস বলল—’হ্যাঁ‌, আজ যাই নৃপতিদা।’

‘নৃপতি বলল—’আচ্ছা‌, এস। সাবধানে পথ চলবে। দক্ষিণ কলকাতার পথেঘাটে এখন দলে দলে পাগল ঘুরে বেড়াচ্ছে।’

এক ধমক হাসির উচ্ছাসের সঙ্গে দেবাশিস বেরিয়ে এল। সে দু’চার পা চলেছে‌, এমন সময় শুনতে পেল দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে গোঁ গোঁ মড়মড় আওয়াজ আসছে। চকিতে আকাশের দিকে চোখ তুলে সে দেখল মেঘ ছুটে আসছে; গুমোট ফেটে ঝড় বেরিয়ে এসেছে। দেখতে দেখতে একঝাঁক জেট বিমানের মত ঝড় এসে পড়ল; বাতাসের প্রচণ্ড দাপটে চারদিক এলোমেলো হয়ে গেল।

দেবাশিস হাওয়ার ধাক্কায় টাল খেতে খেতে একবার ভাবল‌, ফিরে যাই‌, নৃপতিদার বাড়ি বরং কাছে; তারপর ভাবলা‌, ঝড় যখন উঠেছে তখন নিশ্চয় বৃষ্টি নামবে‌, কতক্ষণ ঝড়-বৃষ্টি চলবে ঠিক নেই; সুতরাং বাড়ির দিকে যাওয়াই ভাল‌, হয়তো বৃষ্টি নামার আগেই বাড়ি পৌঁছে যাব।

50 Shares