শজারুর কাঁটা

গুণময়বাবু পলকের জন্যে বুকে একটা তীব্র বেদনা অনুভব করলেন‌, তারপর তাঁর সমস্ত অনুভূতি অসাড় হয়ে গেল।

অতঃপর খবরের কাগজে তুমুল কাণ্ড আরম্ভ হল। একটা বেহেড পাগল শজারুর কাঁটা নিয়ে শহরময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কিন্তু অকৰ্মণ্য পুলিস তাকে ধরতে পারছে না‌, এই আক্ষেপের উম্মা কলকাতার অধিবাসীদের‌, বিশেষত দক্ষিণ দিকের অধিবাসীদের গরম করে তুলল। বৈঠকে বৈঠকে উত্তেজিত জল্পনা চলতে লাগল। সন্ধ্যার পর পার্কের জনসমাগম প্রায় শূন্যের কোঠাতে গিয়ে দাঁড়াল।

এইভাবে দিন দশ-বারো কাটল। বলা বাহুল্য‌, আততায়ী ধরা পড়েনি‌, কিন্তু উত্তেজনার আগুন স্তিমিত হয়ে এসেছে। একদিন ব্যোমকেশের কেয়াতলার বাড়িতে রাত্রি সাড়ে ন’টার পর ইন্সপেক্টর রাখালবাবু এসেছিলেন‌, অজিতও উপস্থিত ছিল; স্বভাবতাই শজারুর কাঁটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল।

অজিত বলল‌,–’কিন্তু এত অস্ত্রশস্ত্র থাকতে শজারুর কাটা কেন?’

রাখালবাবু সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আড়চোখে ব্যোমকেশের পানে তাকালেন; ব্যোমকেশ গম্ভীর মুখে বলল–’সম্ভবত আততায়ীর পোষা শজারু আছে। বিনামূল্যে কাঁটা পায় তাই ছোরাছুরির দরকার হয় না।’

অজিত বলল—’বাজে কথা বলে না। নিশ্চয় কোনো গূঢ় উদ্দেশ্য আছে। আচ্ছা রাখালবাবু্‌, এই যে তিন-তিনটে খুন হয়ে গেল‌, আসামী তিনজন কি একজন সেটা বুঝতে পেরেছেন?’

রাখালবাবু বললেন—’একজন বলেই তো মনে হয়।’

ব্যোমকেশ বলল–’তিনজন হতেও বাধা নেই। মনে কর‌, প্রথমে একজন হত্যাকারী ভিখিরিকে শজারুর কাঁটা দিয়ে খুন করল। তাই দেখে আর একজন হত্যাকারীর মাথায় আইডিয়া খেলে গেল‌, সে একজন ঘুমন্ত মজুরকে কাঁটা দিয়ে খুন করল। তারপর–

‘আর বলতে হবে না‌, বুঝেছি। তিন নম্বর হত্যাকারী তাই দেখে একজন দোকানদারকে খুন করল।’

ব্যোমকেশ বলল–’সম্ভব। কিন্তু যা সম্ভব তাই ঘটেছে এমন কথা বলা যায় না। তার চেয়ে ঢের বেশি ইঙ্গিতপূর্ণ কথা হচ্ছে‌, যারা খুন হয়েছে তাদের মধ্যে একজন ভিখিরি‌, একজন মজুর এবং একজন দোকানদার।’

‘এর মধ্যে ইঙ্গিতপূর্ণ কী আছে‌, আমার বুদ্ধির অগম্য। তোমরা গল্প কর‌, আমি শুতে চললাম।’ অজিত উঠে গেল। তার আর রহস্য-রোমাঞ্চের দিকে ঝোঁক নেই।

রাখালবাবু ব্যোমকেশের পানে চেয়ে মৃদু হাসলেন‌, তারপর গভীর হয়ে বললেন—’সত্যিই কি পাগলের কাজ? নইলে তিনজন বিভিন্ন স্তরের লোককে খুন করবে। কেন? কিন্তু পাগল হলে কি সহজে ধরা যেত না?’

ব্যোমকেশ বলল–’পাগল হলেই ন্যালাক্ষ্যাপা হয় না। অনেক পাগল আছে যারা এমন ধূর্ত যে তাদের পাগল বলে চেনাই যায় না।’

রাখালবাবু বললেন—’তা সত্যি। ব্যোমকেশদা‌, আপনি যতাই থিওরি তৈরি করুন‌, আপনার অন্তরের বিশ্বাস একটা লোকই তিনটে খুন করেছে। আমারও তাই বিশ্বাস। এখন বলুন দেখি‌, যে লোকটা খুন করেছে সে পাগল—এই কি আপনার অন্তরের বিশ্বাস?’

ব্যোমকেশ দ্বিধাভরে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল‌, তারপর কি একটা বলবার জন্যে মুখ তুলেছে এমন সময় দ্রুতচ্ছন্দে টেলিফোন বেজে উঠল। ব্যোমকেশ টেলিফোন তুলে নিয়ে কিছুক্ষণ শুনল‌, তারপর রাখালবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল–’তোমার কলা।’

ফোন হাতে নিয়ে রাখালবাবু বললেন-‘হ্যালো–’ তারপর অপর পক্ষের কথা শুনতে শুনতে তাঁর মুখের ভাব বদলে যেতে লাগল। শেষে-আচ্ছা‌, আমি আসছি বলে তিনি আস্তে আস্তে ফোন রেখে দিলেন‌, বললেন–’আবার শজারুর কাঁটা। এই নিয়ে চার বার হল। এবার উচ্চ শ্রেণীর ভদ্রলোক। কিন্তু আশ্চর্য! ভদ্রলোক মারা যাননি। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’

ব্যোমকেশ চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে বলল–’মারা যাননি?’ রাখালবাবু বললেন—’না। কি যেন একটা রহস্য আছে। আমি চলি। আসবেন নাকি?’ ব্যোমকেশ বলল—’অবশ্য।’

কাহিনী

দক্ষিণ কলকাতার ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের নতুন রাস্তার ওপর একটি ছোট দোতলা বাড়ি। বাড়ির চারিদিকে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। খোলা জায়গায় এখানে ওখানে কয়েকটা অনাদৃত ফুলের গাছ।

বাড়িটি কিন্তু অনাদৃত নয়। বাড়ির বহিরঙ্গ যেমন ফিকে নীল রঙে রঞ্জিত এবং সুশ্রী‌, ভিতরটিও তেমনি পরিচ্ছন্ন ছিমছাম। নীচের তলায় একটি বসবার ঘর; তার সঙ্গে খাবার ঘর‌, রান্নাঘর এবং চাকরের ঘর। দোতলায় তেমনি একটি অন্তরঙ্গ বসবার ঘর এবং দু’টি শয়নকক্ষ। বছর চার-পাঁচ আগে যিনি এই বাড়িটি প্রৌঢ় বয়সে তৈরি করিয়েছিলেন তিনি এখন গতাসু, তাঁর একমাত্র পুত্র দেবাশিস এখন সস্ত্রীক এই বাড়িতে বাস করে।

একদিন চৈত্রের অপরাহ্নে দোতলার বসবার ঘরে দীপা একলা বসে রেডিও শুনছিল। দীপা দেবাশিসের বউ; মাত্র দু’মাস তাদের বিয়ে হয়েছে। দীপা একটি আরাম-কেদারায় হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে ছিল। ঘরে আসবাব বেশি নেই; একটি নীচু টেবিল ঘিরে কয়েকটি আরাম-কেদারা; দেয়াল ঘেঁষে একটি তক্তপোশ‌, তার ওপর ফরাশ ও মোটা তাকিয়া। এ ছাড়া ঘরে আছে রেডিওগ্রাম এবং এক কোণে টেলিফোন।

রেডিওগ্রামের ঢাকনির ভিতর থেকে গানের মৃদু গুঞ্জন আসছিল। ঘরটি ছায়াচ্ছন্ন‌, দোর জানিলা ভেজানো। দীপা চেয়ারের পিঠে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে ছিল। বাড়িতে একলা তার সারা দুপুর এমনিভাবেই কাটে।

দীপার এই আলস্যশিথিল চেহারাটি দেখতে ভাল লাগে। তার রঙ ফসইি বলা যায়‌, মুখের গড়ন ভাল; কিন্তু ভ্রূর ঋজু রেখা এবং চিবুকের দৃঢ়তা মুখে একটা অপ্রত্যাশিত বলিষ্ঠতা এনে দিয়েছে‌, মনে হয়। এ মেয়ে সহজ নয়‌, সামান্য নয়।

50 Shares