দেবাশিস ঝড়ের প্রতিকূলে মাথা ঝুকিয়ে চলতে লাগল। কিন্তু বেশি দূর চলতে হল না, বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল; বরফের মত ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা তার সবঙ্গে ভিজিয়ে দিল।
বাড়িতে ফিরে দেবাশিস সটান ওপরে চলে গেল। দীপা নিজের ঘরে ছিল, বন্ধ জানলার কাচের ভিতর দিয়ে বৃষ্টি দেখছিল; দেবাশিস জোরে টোকা দিয়ে ঘরে ঢুকতেই সে ফিরে দাঁড়িয়ে দেবাশিসের সিক্ত মূর্তি দেখে সশঙ্ক নিশ্বাস টেনে চক্ষু বিস্ফারিত করল। দেবাশিস লজ্জিতভাবে ‘ভিজে গেছি বলে বাথরুমে ঢুকে পড়ল।
দশ মিনিট পরে শুকনো জামাকাপড় পরে সে বেরিয়ে এল, তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে দেখল, দীপা যেমন ছিল তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। সে বলল—’নৃপতিবার বাড়ি থেকে বেরিয়েছি আর ঝড়-বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেল। চল, খাবার সময় হয়েছে।’
পরদিন সকালে গায়ে দারুণ ব্যথা নিয়ে দেবাশিস ঘুম থেকে উঠল। বৃষ্টিতে ভেজার ফল, সন্দেহ নেই; হয়তো ইনফ্লুয়েঞ্জায় দাঁড়াবে। দেবাশিস ভাবল আজ আর কাজে যাবে না। কিন্তু সারা দিন বাড়িতে থাকলে বার বার দীপার সংস্পর্শে আসতে হবে, নিরর্থক কথা বলতে হবে; সে লক্ষ্য করেছে। রবিবারে দীপা যেন শঙ্কিত আড়ষ্ট হয়ে থাকে। কী দরকার? সে গায়ের ব্যথার কথা কাউকে বলল না, যথারীতি খাওয়া-দাওয়া করে ফ্যাক্টরি চলে গেল।
বিকেলবেলা সে গায়ে জ্বর নিয়ে বাড়ি ফিরল। জলখাবার খেতে বসে সে নকুলকে বলল–’নকুল, আমার একটু ঠাণ্ডা লেগেছে, রাত্তিরে ভাত খাবো না।’
নকুল বলল—’কাল রাত্তিরে যা ভেজাটা ভিজেছ, ঠাণ্ডা তো লাগবেই। তা ডাক্তারবাবুকে খবর দেব? ‘
দেবাশিস বলল—’আরে না না, তেমন কিছু নয়। গোটা দুই অ্যাসপিরিন খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।’
রাত্রে সে খেতে নামল না। খাবার সময় হলে দীপা নীচে গিয়ে নকুলকে বলল–’নকুল, ওর খাবার তৈরি হয়ে থাকে তো আমাকে দাও, আমি নিয়ে যাই।’
নকুল একটা ট্রে-র উপর সুপের বাটি, টোস্ট এবং স্যালাড সাজিয়ে রাখছিল, বলল–’সে কি বউদি, তুমি দাদাবাবুর খাবার নিয়ে যাবে! আমি তাহলে রয়েছি কি কত্তে? নাও, চল।’
ট্রে নিয়ে নকুল আগে আগে চলল, তার পিছনে দীপা। দীপার মন ধুকপুক করছে। ওপরে উঠে নকুল যখন দীপার ঘরের দিকে চলল, সে তখন ক্ষীণ কুষ্ঠিত স্বরে বলল—‘ওদিকে নয় নকুল, এই ঘরে।’
নকুল ফিরে দাঁড়িয়ে দীপার পানে তীক্ষ্ণ চোখে চাইল, তারপর অন্য ঘরে গিয়ে দেখল দেবাশিস বিছানায় শুয়ে বই পড়ছে। নকুল খাটের পাশে গিয়ে সন্দেহভরা গলায় বলল—’তুমি এ ঘরে শুয়েছ যে, দাদাবাবু!’
ইনফ্লুয়েঞ্জা ধরেছে তাই আলাদা শুয়েছি। ছোঁয়াচে রোগ, শেষে দীপাকেও ধরবে।’
সন্তোষজনক কৈফিয়ত। দীপা নিশ্বাস ফেলে বাঁচল। নকুলও আর কিছু বলল না, কিন্তু তার চোখ সন্দিগ্ধ হয়ে রইল। সে যেন বুঝেছে, যেমনটি হওয়া উচিত ঠিক তেমনটি হচ্ছে না, কোথাও একটু গলদ রয়েছে।
ঘণ্টা তিনেক পরে দীপা নিজের ঘরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল, দোরে ঠকঠক শব্দ শুনে তার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম-চোখে উঠে দোর খুলেই সে প্রায় অতিকে উঠল। দেবাশিস বিছানার চাদর গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে। সে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল—’বুকে দারুণ ব্যথা, জ্বরও বেড়েছে…ডাক্তারকে খবর দিতে হবে।’ এই বলে সে টলতে টলতে নিজের ঘরে ফিরে গেল।
আকস্মিক বিপৎপাত মানুষের মন ক্ষণকালের জন্য অসাড় হয়ে যায়। তারপর সংবিৎ ফিরে আসে। দীপা স্বস্থ হয়ে ভাবল, ডাক্তার ডাকতে হবে; কিন্তু এ বাড়ির বাঁধা। ডাক্তার কে তা সে জানে না, তাঁকে ডাকতে হলে নকুলকে পাঠাতে হবে; তাতে অনেক দেরি হবে। তার চেয়ে যদি সোনকাকাকে ডাকা যায়–
দীপা ডাক্তার সুহৃৎ সেনকে টেলিফোন করল। ডাক্তার সেন দীপার বাপের বাড়ির পারিবারিক ডাক্তার।
একটি নিদ্ৰালু স্বর শোনা গেল-‘হ্যালো।’
দীপা বলল–’সোনকাকা! আমি দীপা।’
‘দীপা! কী ব্যাপার?’
‘আমি-আমার-? দীপা ঢোক গিলল—’আমার স্বামী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, এখনই ডাক্তার চাই। আমি জানি না। এঁদের ডাক্তার কে, তাই আপনাকে ডাকছি। আপনি এক্ষুনি আসুন সেনকাকা।’
‘এক্ষুনি যাচ্ছি। কিন্তু অসুখের লক্ষণ কি?
‘বৃষ্টিতে ভিজে ঠাণ্ডা লেগেছিল–তারপর–’
‘আচ্ছা, আমি আসছি।’
‘বাড়ি চিনে আসতে পারবেন তো?’
‘খুব পারব! এই তো সেদিন তোমার বউভাতের নেমন্তন্ন খেয়েছি।’
মিনিট কুড়ির মধ্যে ডাক্তার সেন এলেন, ওপরে গিয়ে দেবাশিসের পরীক্ষা শুরু করলেন। দীপা দোরের চৌকাঠে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল।
প্রথমে কয়েকটা প্রশ্ন করে ডাক্তার রোগীর নাড়ি দেখলেন, টেম্পরেচার নিলেন, তারপর স্টেথস্কোপ কানে লাগিয়ে বুক পরীক্ষা করতে লাগলেন। পরীক্ষা করতে করতে তাঁর চোখ হঠাৎ বিস্ফারিত হল, তিনি বলে উঠলেন–’এ কি?’
দেবাশিস ক্লিষ্ট স্বরে বলল—’হ্যাঁ ডাক্তারবাবু্, আমার সবই উল্টে।’
দীপা সচকিত হয়ে উঠল, কিন্তু দেবাশিস আর কিছু বলল না। ডাক্তার কেবল ঘাড় নাড়লেন।
পরীক্ষা শেষ করে ডাক্তার বললেন–‘বুকে বেশ সর্দি জমেছে। আমি ইঞ্জেকশন দিচ্ছি, তাতেই কাজ হবে। আবার কাল সকালে আমি আসব, যদি দরকার মনে হয় তখন রীতিমত চিকিৎসা আরম্ভ করা যাবে।’
ইঞ্জেকশন দিয়ে দেবাশিসের মাথায় হাত বুলিয়ে ডাক্তার সস্নেহে বললেন–‘ভয়ের কিছু নেই, দু’ চার দিনের মধ্যেই সেরে উঠবে। আচ্ছা, আজ ঘুমিয়ে পড় বাবাজি, কাল ন’টার সময় আবার আমি আসব। তোমার বাড়ির ডাক্তারকেও খবর দিও।’
ডাক্তার ঘর থেকে বেরুলেন, দীপা তাঁর সঙ্গে সঙ্গে গেল। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে ডাক্তার সেন দীপাকে বললেন–‘একটা বড় আশ্চর্য ব্যাপার দেখলাম–’