প্রবাল গলার মধ্যে অবজ্ঞাসূচক শব্দ করল। কপিল বলল—’সম্ভবত নামজাদা ফুটবল খেলোয়াড়।’
খড়্গ বাহাদুর বলল—’কিংবা নামজাদা সিনেমা অ্যাক্টর।’
সুজন বলল–’কিংবা নাম-করা গাইয়ে।’
প্রবাল বলল-নাম-করা লোককেই মারবে এমন কী কথা আছে? পয়সাওয়ালা লোককেও মারতে পারে। যেমন নৃপতিদা কিংবা কপিল কিংবা-’
এই সময় দীপা খাবারের টুে হাতে দোরের সামনে এসে দাঁড়াল। প্রবালের কথা শেষ হল না, সবাই হাসিমুখে উঠে। দীপকে মহিলার সম্মান দেখাল। দীপা একবার ত্রাস-বিস্ফারিত চোখ সকলের দিকে ফেরাল, তার মুখ সাদা হয়ে গেল। প্রবল চেষ্টায় সে নিজের দেহটাকে সামনে চালিত করে টেবিলের ওপর খাবারের ট্রে রাখল।
কপিল মৃদু ঠাট্টার সুরে বলল—’নমস্কার, মিসেস ভট্ট।’
দীপা বোধ হয় শুনতে পেল না, সে ট্রে রেখেই পিছু ফিরল। তার পিছনে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে নকুল ছিল, তাকে পাশ কাটিয়ে দীপা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
দেবাশিস অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। সে আশা করেছিল, দীপা সকলকে চা ঢেলে দেবে, সকলেই বিয়ের আগে থেকে পরিচিত, তাদের সঙ্গে বসে কথাবার্তা বলবে, তাদের খাওয়ার তদারক করবে। কিন্তু দীপা কিছুই করল না। দেবাশিস নিজেই সকলকে চা ঢেলে দিল। ট্রের ওপর থেকে খাবারের প্লেট নামিয়ে তাদের সামনে রাখল। দীপা আজ নকুলের সাহায্যে অনেক রকম খাবার তৈরি করেছিল; চিংড়ি মাছের কাটলেট, হিঙের কচুরি, ডালের ঝালবড়া, রাঙালুর পুলি, জমাট ক্ষীরের বিরফি ইত্যাদি। অতিথিরা খেতে খেতে আবার তর্কবিতর্কে মশগুল হয়ে উঠল। দীপার ব্যবহারে সামান্য অস্বাভাবিকতা কেউ লক্ষ্যও করল। কিনা বলা যায় না।
আলোচনা যখন বেশ জমে উঠেছে তখন দেবাশিস অতিথিদের দৃষ্টি এড়িয়ে রান্নাঘরে গেল। দেখল, দীপা টেবিলের ওপর কনুই রেখে আঙুল দিয়ে দুই রাগ টিপে বসে আছে। দেবাশিস তার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সে হতাশ চোখ তুলে বলল-বিড় মাথা ধরেছে।’
দেবাশিসের মন মুহুর্তমধ্যে হাল্কা হয়ে গেল। সে সহানুভূতির সুরে বলল–’ও—আগুনের তাতে মাথা ধরেছে। তুমি আর এখানে থেকে না, নিজের ঘরে চলে যাও, মাথায় অডিকলোন দিয়ে শুয়ে থাকো গিয়ে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে মাথা ধরা সেরে যাবে।’
দীপা উঠে দাঁড়িয়ে ক্ষীণস্বরে বলল—’আচ্ছা।’
দেবাশিস বসবার ঘরে ফিরে গিয়ে বলল–’দীপার খুব মাথা ধরেছে। আমি তাকে মাথায় অডিকেলন দিয়ে শুয়ে থাকতে বলেছি। আজ সারা দুপুর উনুনের সামনে বসে খাবার তৈরি করেছে।’
সকলেই সহানুভুতিসূচক শব্দ উচ্চারণ করল। বিজয় উঠে দাঁড়িয়ে বলল–’আমি যাই, দীপাকে একবার দেখে আসি।’
দেবাশিস বলল—’যাও-না, সোজা ওপরে চলে যাও।’
বিজয় দোতলায় গিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দীপার শোবার ঘরের দোরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দীপা চোখ বুজে শুয়ে ছিল, সাড়া পেয়ে ঘাড় তুলে বিজয়কে দেখল, তারপর আবার বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজল।
বিজয় খাটের পাশে এসে দাঁড়াল, কটমট করে দীপার পানে চেয়ে থেকে চাপা তর্জনে বলল–’আমার সঙ্গে চালাকি করিসনে, তোর মাথাধরার কারণ আমি বুঝেছি।’
দীপা উত্তর দিল না, চোখ বুজে পড়ে রইল। বিজয় তর্জনী তুলে বলল—’আজ যারা এসেছে তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে তোর ইয়ে—।’
দীপার কাছ থেকে সাড়াশব্দ নেই।
‘তার নাম কি, বল।’
দীপার মুখে কথা নেই, সে যেন কালা হয়ে গেছে।
‘বলবি না?’
এইবার দীপা ঝাঁকানি দিয়ে উঠে বসল, তীব্র দৃষ্টিতে বিজয়ের পানে চেয়ে বলল—’না, বলব না।’ এই বলে সে বিজয়ের দিকে পিছন ফিরে আবার শুয়ে পড়ল।
দাঁতে দাঁত চেপে বিজয় বলল-‘বলবিনে! আচ্ছা, আমিও দেখে নেব। যেদিন ধরব তাকে, চৌ-রাস্তার ওপর টেনে এনে জুতো পেটা করব।’
বিজয় নীচে নেমে গেল। ভাই-বোনের ঝগড়ার মূলে যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। কিন্তু ব্যাপারটা কেমন যেন হাস্যকর হয়ে দাঁড়াল–
তারপর আবার দিন কাটছে।
প্রত্যেক মানুষের দুটো চরিত্র থাকে; একটা তার দিনের বেলার চরিত্র, অন্যটা রাত্রির। বেরালের চোখের মত; দিনে একরকম, রাত্রে অন্যরকম।
এই কাহিনীতে যে ক’টি চরিত্র আছে তাদের মধ্যে পাঁচজনের নৈশ জীবন সম্বন্ধে অনুসন্ধান করা যেতে পারে। হয়তো অপ্রত্যাশিত নতুন তথ্য জানা যাবে।
একটি রাত্রির কথা :
সাড়ে দশটা বেজে গেছে। নৃপতি নৈশাহার শেষ করে নিজের শোবার ঘরে বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিল। জোড়া-খাটের ওপর চওড়া বিছানা; তার বিবাহিত জীবনের খাট-বিছানা। এখন সে একাই শোয়। শুয়ে বই পড়ে, বই পড়তে পড়তে ঘুম এলে বই বন্ধ করে আলো নিবিয়ে দেয়।
আজ কিন্তু বই পড়তে পড়তে তার মন ছটফট করছে, পড়ায় মন বসছে না। প্ৰায় আধা ঘণ্টা বইয়ে মন বসাবার বৃথা চেষ্টা করে সে উঠে পড়ল, আলো নিবিয়ে জানলার নীচে আরাম-চেয়ারে এসে বসল। আকাশে চাঁদ আছে, বাইরে জ্যোৎস্নার প্লাবন। সে সিগারেট ধরাল।
আজ কোন তিথি? পূর্ণিমা নাকি? হগুপ্ত দুই আগে নৃপতি যখন গভীর রাত্রে বেরিয়েছিল তখন কৃষ্ণপক্ষ ছিল, বোধ হয় অমাবস্যা। মানুষের মনের সঙ্গে তিথির কি কোনো সম্পর্ক আছে? একাদশী অমাবস্যা পূর্ণিমাতে বাতের ব্যথা বাড়ে, একথা আধুনিক ডাক্তারেরাও স্বীকার করেন। নৃপতি গলার মধ্যে মৃদু হাসল। বাতের ব্যথাই বটে।
‘বাবু!’
নৃপতির খাস চাকর দীননাথ তার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। নৃপতি পাশের দিকে ঘাড় ফেরাল। দিনু বলল–’আপনার ঘুম আসছে না, এক কাপ ওভালটিন তৈরি করে দেব?
নৃপতি একটু ভেবে বলল-না, থাক। আমি বেরুবা, তুই শেষ রাত্রে দোর খুলে রাখিস।’