শজারুর কাঁটা

‘আচ্ছা‌, বাবু।’

দিনু প্রভুভক্ত চাকর; সে জানে নৃপতি মাঝে মাঝে নিশাভিসারে বেরোয়‌, কিন্তু কাউকে বলে না। বাড়ির অন্য চাকর-বাকর ঘৃণাক্ষরেও জানতে পারে না।

দিনু চলে যাবার পর নৃপতি উঠে আলো জ্বালল‌, ওয়ার্ডরোব থেকে এক সেট ধূসর রঙের বিলিতি পোশাক বের করে পরল‌, পায়ে রবার-সোল জুতো পরল; স্টিলের কাবার্ড থেকে একটা চশমার খাপের মত লম্বাটে পার্স নিয়ে বুকপকেটের ভিতর দিকে রাখল। তারপর ছফুট লম্বা আয়নায় নিজের চেহারা একবার দেখে নিয়ে আলো নিবিয়ে দিল। বাড়ির পিছন দিকে চাকরদের যাতায়াতের জন্যে ঘোরানো লোহার সিড়ি‌, সেই সিঁড়ি দিয়ে নিঃশব্দে নীচে নেমে গেল।

নৃপতি কোথায় যায়? সে বিপত্নীক‌, তার কি কোনো গুপ্ত প্রণয়িনী আছে?

আর একটি রাত্রির কথা :

গোল পার্ক থেকে যে কটা সরু রাস্তা বেরিয়েছে তারই একটা দিয়ে কিছুদূর গেলে একটা পুরনো দোতলা বাড়ি চোখে পড়ে; এই বাড়ির একতলায় গোটা তিনেক ঘর নিয়ে প্রবাল গুপ্ত থাকে। পুরনো বাড়ির পুরনো ভাড়াটে; ভাড়া কম দিতে হয়।

বাসাটি মন্দ নয়। কিন্তু প্রবালের প্রকৃতি একটু অগোছালো‌, তাই তার স্ত্রী মারা যাবার পর বাসাটি শ্ৰীহীন হয়ে পড়েছে। সদরের বসবার ঘরে মেঝের ওপর শতরঞ্জি পাতা। দেয়াল ঘেঁষে এক জোড়া বাঁয়োতবলা‌, হারমোনিয়াম এবং তাল রাখার একটা ছোট যন্ত্র। প্রবাল যে সঙ্গীতশিল্পী্‌্‌, বাসায় এ ছাড়া তার অন্য কোনো নিদর্শন নেই।

রাত্রি সাড়ে আটটার সময় প্রবাল সদর দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছিল। আজ সে নৃপতির আড্ডায় যায়নি। একটা গানে সুর লাগিয়ে তৈরি করছিল‌, আসছে হাপ্তায় দমদমে গিয়ে সেটা রেকর্ড করতে হবে। সে নিজেই গানে সুর দেয়; আজ গানটাকে ঠিক রেকর্ডের মাপে তৈরি করছিল। তিন মিনিট কুড়ি সেকেণ্ডের মধ্যে গান গেয়ে শেষ করতে হবে।

তালের যন্ত্রটাতে দম দিয়ে সে চালু করে দিল‌, যন্ত্রটা ঘড়ির দোলকের মত কটকটু শব্দ করে দুলতে লাগল। প্রবাল পকেট থেকে স্টপ-ওয়াচ বের করে হারমোনিয়ামের ওপর রাখল‌, তারপর স্টপ-ওয়াচের মাথা টিপে চালিয়ে দিয়ে মৃদুকণ্ঠে গাইতে আরম্ভ করল‌, তার আঙুল খুব লঘু স্পর্শে হরমোনিয়ামের চাবির ওপর খেলে বেড়াতে লাগল।

গান শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সে স্টপ-ওয়াচ বন্ধ করল‌, দেখল তিন মিনিট একত্রিশ সেকেন্ড হয়েছে। সে তখন তালের যন্ত্রটাকে চাবি ঘুরিয়ে একটু দ্রুত করে দিয়ে আবার স্টপ-ওয়াচ ধরে গাইতে শুরু করল।

এইভাবে প্ৰায় আধা ঘণ্টা চলল। নিঃসঙ্গ গায়ক আপন মনে গেয়ে চলেছে।

দোরে খট্‌খট্‌ করে টোকা পড়ল। প্রবাল উঠে গিয়ে দোর খুলে দিল; একটা চাকর এক থালা অন্ন-ব্যঞ্জন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রবালের বাসায় রান্নাবান্নার কোনো ব্যবস্থা নেই; কাছেই একটা হোটেল আছে‌, সেখান থেকে দু’ বেলা তার খাবার দিয়ে যায়।

চাকরটি শতরঞ্জির এক কোণে থালা রেখে চলে গেল। প্রবাল দোর বন্ধ করে সেখানেই খেতে বসল। এমনিভাবে সে যেন দিনগত পাপক্ষয় করে চলেছে। হয়তো দূর ভবিষ্যতের ওপর দৃষ্টি রেখে সে চলেছে‌, তাই বর্তমান সম্বন্ধে তার মন সম্পূর্ণ উদাসীন।

নৈশাহার শেষ করে প্রবাল বাসায় তালা লাগিয়ে বেরুল। মোড়ের মাথায় একটা পানের দোকান আছে‌, সেখানে গিয়ে পান। কিনে মুখে দিল‌, একটা গোল্ড ফ্লেন্ক সিগারেট ধরাল। প্রবাল নিজের কাছে সিগারেট রাখে না‌, পাছে বেশি খাওয়া হয়ে যায়; প্রত্যহ রাত্রে দোকান থেকে একটি সিগারেট কিনে খায়। যারা পেশাদার গাইয়ে‌, গলা সম্বন্ধে তাদের সতর্কতার অন্ত নেই। বেশি। ধূমপান করলে নাকি গলা খারাপ হয়ে যায়।

পানের দোকানো একটি ছোট্ট ট্রানজিস্টার গুনগুন করে গান গেয়ে চলেছে। প্রবাল শুনল‌, তারই গাওয়া একটি গানের রেকর্ড বাজছে। সে ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ নিজের গাওয়া গান শুনল‌, তারপর সিগারেট টানতে টানতে এগিয়ে চলল।

সাদার্ন অ্যাভেনু তখন জনবিরল হয়ে এসেছে। প্রবাল রবীন্দ্র সরোবরের রেলিং-এর ধার দিয়ে দক্ষিণ দিকে চলল। তার মগজের মধ্যে কখনও গানের কলি গুঞ্জন তুলছে..প্রেমের সাগর দুলে দুলে ওঠে সখি…। কখনও একটা ক্রুদ্ধ ভোমরা ঝঙ্কার দিয়ে উঠছে.দুনিয়ায় যার টাকা নেই সে কিসের লোভে বেঁচে থাকে?…

রবীন্দ্র সরোবরের রেলিং অনেক দূর এসে যেখানে পুব দিকে মোড় ঘুরেছে তার কাছাকাছি একটা খিড়কির ফটক আছে। প্রবাল সেই ফটক দিয়ে লেকের বেষ্টনীর মধ্যে প্রবেশ করল।

ঝিলিমিলি আবছা আলোয় কিছুদূর যাবার পর একটা গাছের তলায় শূন্য বেঞ্চি চোখে পড়ল। প্রবাল বেঞ্চিতে গিয়ে বসল‌, তারপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। তার গলার মধ্যে অবরুদ্ধ হাসির মত শব্দ হল। …

সেরাত্রে প্রবাল যখন বাসায় ফিরল। তখন বারোটা বাজতে বেশি দেরি নেই। কলকাতা শহরের চোখ তন্দ্ৰায় ঢুলু ঢুলু।

আর একটি রাত্রির কথা :

খড়্গ বাহাদুর আজ আড্ডায় যায়নি; তার কারণ তার বাড়িতেই আজ আড্ডা বসবে। অবশ্য অন্যরকম আড্ডা; অতিথিরাও অন্য। এইরকম আডা মাসে দু’ তিন বার বসে।

খড়্গ বাহাদুর একটি ছোট ফ্ল্যাটে থাকে। ছোট হলেও ফ্ল্যাটটি তার পক্ষে যথেষ্ট। সে একলা থাকে‌, সঙ্গী একমাত্র স্বদেশী সেবক রতন সিং। রতন সিং একাধারে তাঁর ভৃত্য এবং পাচক‌, ভাল শিককাবাব তৈরি করতে পারে।

সামনের ঘরটি পরিপাটিভাবে সাজানো‌, দেখলেই বোঝা যায় অবস্থাপন্ন লোকের বাড়ি। মাঝখানে একটি তাঁস খেলার টেবিল ঘিরে গোটা চারেক গদি-মোড়া চেয়ার‌, মাথার ওপর একশো ওয়াটের দুটো বালব জ্বলছে। এই টেবিলের সামনে একলা বসে খড়্গ বাহাদুর এক প্যাক তাস নিয়ে ভাঁজিছিল। আরো দুটো নতুন তাসের সীল-করা প্যাক পাশে রাখা রয়েছে। খড়্গ বাহাদুর অলসভাবে তাস ভাঁজছিল‌, কিন্তু তার মুখের ভাব কড়া এবং রুক্ষ। নৃপতির আড্ডায় তার যেমন হাসিখুশি মিশুক ভাব দেখা যায়‌, বাড়িতে ঠিক তেমন নয়। বাড়িতে সে প্রভু। মধ্যযুগীয় প্রভু।

50 Shares