পৌঁনে আটটা বাজলে খড়্গ বাহাদুর ডাকল—’রতন সিং!’
রতন সিং রান্নাঘরে ছিল, বেরিয়ে এসে প্রভুর সামনে দাঁড়াল। বেঁটেখাটো মানুষ, খাঁটি নেপালী চেহারা; ভাবলেশহীন। তির্যক চোখে চেয়ে বলল—’জি।’
খড়্গ বাহাদুর বলল—’আটটার পরেই অতিথিরা আসবে। শিককাবাব কত দূর?
রতন সিং বলল–’জি, আধা তৈরি হয়েছে, আধা তৈরি হচ্ছে।’
খড়্গ বলল–’তিনজন অতিথি আসবে। তারা সকলে এলে প্রথম দফা শিককাবাব দিয়ে যাবে, এক ঘণ্টা পরে দ্বিতীয় দফা দেবে। যাও।’
রতন সিং-এর মুখ দেখে নিঃসংশয়ে কিছু বোঝা যায় না; তবু সন্দেহ হয়, মালিকের অতিথিদের সে পছন্দ করে না। সে রান্নাঘরে ফিরে গিয়ে আবার শিককাবাব রচনায় মন দিল। মালিক যা করেন। তাই অভ্রান্ত বলে মেনে নিতে হয়, কিন্তু জুয়া খেলে টাকা ওড়ানো ভাল কাজ নয়। দেশ থেকে প্রতিমাসে এক হাজার টাকা আসে, অথচ মাসের শেষে এক পয়সাও বাঁচে না।
বাইরের ঘরে তাস ভাঁজতে ভাঁজতে খড়্গ বাহাদুর ভাবছিল—আজ যদি হেরে যাই, রক্তদর্শন করব।
গত কয়েকবার সে ক্রমাগত হেরে আসছে।
আটটার সময় একে একে তিনটি অতিথি এল। তিনজনেই যুবক, সাজপোশাক দেখে বোঝা যায়, তিনজনেই বড়মানুষের ছেলে। একজন সিন্ধী, দ্বিতীয়টি পাঞ্জাবী, তৃতীয়টি পার্সী।
সংক্ষিপ্ত সম্ভাষণের পর সকলে টেবিল ঘিরে বসল। রতন সিং চারটি প্লেটে প্রায় সেরখানেক শিককাবাব এনে রাখল; সঙ্গে রাই-বাটা এবং ছুরি-কাঁটা।
কথাবার্তা বেশি হল না, চারজন প্লেট টেনে নিয়ে ছুরি-কাঁটার সাহায্যে খেতে আরম্ভ করল। রতন সিং-এর শিককাবাব অতি উপাদেয়। অল্পক্ষণের মধ্যেই চারটি প্লেট শূন্য হয়ে গেল। সকলে রুমালে মুখ মুছে সিগারেট ধরাল। পাসী যুবকও সিগারেট খায়, আধুনিক যুবকেরা ধর্মের নিষেধ মানে না।
তারপর সাড়ে আটটার সময় তাসের নতুন প্যাক খুলে খেলা আরম্ভ হল। তিন তাসের খেলা, জোকার নেই। নিম্নতম বাজি পাঁচ টাকা, ঊর্ধ্বতম বাজি কুড়ি টাকা।
চারজনই পাকা খেলোয়াড়। কিন্তু রানিং ফ্লাশ খেলায় ক্রীড়ানৈপুণ্যের বিশেষ অবকাশ নেই, ভাগ্যই বলবান। কদাচিৎ ব্লাফ দিয়ে দু’এক দান জেতা যায়। আসলে হাতের জোরের ওপরেই খেলার হার-জিত।
সাড়ে দশটার সময় আর এক দফা শিককাবাব এল। এবার মাত্ৰা কিছু কম। সঙ্গে কফি। পনেরো মিনিটের মধ্যে খাওয়া শেষ করে আবার নতুন তাসের প্যাক খুলে খেলা আরম্ভ হল।
খেলা শেষ হল রাত্রি সাড়ে বারোটার সময়। হিসেবনিকেশ করে দেখা গেল, অতিথিরা তিনজনেই জিতেছে, খড়্গ বাহাদুর হেরেছে প্রায় সাত শো টাকা!
অতিথিরা হাসিমুখে সহানুভূতি জানিয়ে চলে গেল! খড়্গ বাহাদুর অন্ধকার মুখে অনেকক্ষণ একলা টেবিলের সামনে বসে রইল, তারপর হঠাৎ উঠে শোবার ঘরে গেল। বেশ পরিবর্তন করে মাথায় একটা কাউ-বয় টুপি পরে বেরিয়ে এল। রতন সিংকে বলল—’আমি বেরুচ্ছি। যতক্ষণ না ফিরি, তুমি দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে জেগে থাকবে।’
রতন সিং বলল–’জি।’
খড়্গ বাহাদুর বেরিয়ে গেল। রতন সিং-এর মঙ্গোলীয় মুখ নির্বিকার রইল বটে, কিন্তু তার ছোট ছোট চোখ দু’টি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। মালিক আজও হেরেছেন। তাঁস খেলায় হেরে মালিক কোথায় যান? ফিরে আসেন। সেই শেষ রাত্রে। কখনও আটটার আগেই বেরিয়ে যান, ফিরতে রাত হয়। কোথায় থাকেন? রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান? কিংবা—
আর একটি রাত্রির কথা :
কপিলের বাড়িতে নৈশ আহার শেষ হয়েছিল। কর্তা নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন, কপিলের ছোট দুই ভাইবোনও নিজের নিজের ঘরে চলে গিয়েছিল। ড্রয়িংরুমে এসে বসেছিল কপিল, তার দাদা আর বউদিদি এবং তার দিদি ও জামাইবাবু। কর্তা বিপত্নীক, পুত্রবধূই বাড়ির গিন্নি। মেয়ে-জামাই দাৰ্জিলিঙে থাকে, জামাইয়ের চায়ের বাগান আছে; আজ সকালে কয়েক দিনের জন্যে তারা কলকাতায় এসেছে।
কপিলদের বাড়িটা তিনতলা। নীচের তলায় একটা বড় ব্যাঙ্কের শাখা, উপরের দু’টি তলায় কপিলেরা থাকে। সবার উপরে প্রশস্ত খোলা ছাদ।
ড্রয়িং রুমে যাঁরা সমবেত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে কপিলের দাদা গৌতমদেব বয়সে বড়। পৈতৃক সলিসিটার অফিসের তিনি এখন কতা। অত্যন্ত নির্লিপ্ত প্রকৃতির লোক; বাড়িতে কারুর সাতে-পাঁচে থাকেন না। তাঁর স্ত্রী রমলার প্রকৃতি কিন্তু অন্যরকম। তার বয়স ত্ৰিশের বেশি নয়, কিন্তু সে বুদ্ধিমতী, গৃহকর্মে নিপুণা, সংসারের কোনো ব্যাপারেই নির্লিপ্ত নয়। উপরন্তু তার বুদ্ধিতে একটু অন্নারস মেশানো আছে, যার ফলে সকলেই তার কাছে একটু সতর্ক হয়ে থাকে।
কপিলের দিদি অশোকার বয়সও আন্দাজ ত্রিশ। তার সাত বছরের একটিমাত্র ছেলে স্কুলের বোর্ডি-এ থাকে। অশোকার চরিত্র সম্বন্ধে এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, সে বড়মানুষের মেয়ে, বড়মানুষের বউ। পৃথিবীর অধিকাংশ জীবকেই সে করুণার চক্ষে দেখে, কারুর সঙ্গে বেশি কথাবার্তা বলে না। তার স্বামী শৈলেনবাবু কিন্তু মজলিসী লোক; আসার জমিয়ে গল্প করতে ভালবাসেন, তর্ক করার দিকে ঝোঁক আছে এবং সুযোগ পেলে অযাচিত উপদেশও দিয়ে থাকেন।
তিনি প্রকাণ্ড জিজ্ঞাসা-চিহ্নের মত একটি পাইপের মুণ্ড মুঠিতে ধরে ধূমপান করছেন। গৌতমদেব একটি মোটা সিগারেট ধরিয়েছেন। কপিলের নাকে তামাকের সুগন্ধ ধোঁয়া আসছে; কিন্তু সে গুরুজনদের সামনে ধূমপান করে না, তাই নীরবে বসে উসখুসি করছে। বাড়ির নিয়ম, নৈশাহারের পর সকলে অন্তত পনেরো মিনিটের জন্যে একত্র হবে। আগে কিতাও এসে বসতেন; এখন তাঁর বয়স বেড়েছে, খাওয়ার পরই শুয়ে পড়েন। বাড়ির অন্য সকলের জন্য কিন্তু নিয়ম জারি আছে।