শজারুর কাঁটা

রমলা গলা নীচু করল–’তোমার মতলব ভাল ঠেকছে না ঠাকুরপো।’

কপিল বলল–’কি মুশকিল। আমি তো প্রায়ই আকাশের তারা দেখবার জন্যে ছাদে উঠি। তুমি জান না?’

রমলা বলল—’জানি। কিন্তু সে তো সন্ধ্যের পর। আজ রাত দুপুরে কোন তারা দেখবে বলে ছাদে উঠিছ?’

কপিল বলল–’আজ রাত্রি পৌঁনে বারোটার সময় মঙ্গলগ্রহ ঠিক মাথার ওপর উঠবে। মঙ্গলগ্রহ এখন পৃথিবীর খুব কাছে এসেছে‌, তাই তাকে ভাল করে দেখবার জন্যে ছাদে যাচ্ছি।’

রমলা মুখ গভীর করে বলল—’হঁ‌, মঙ্গলগ্রহ। কোন গ্রহ-তারা তোমার ঘাড়ে চেপেছে তুমিই জান। কিন্তু একটা কথা বলে দিচ্ছি‌, আমাদের বাড়ির চার পাশে যাদের বাড়ি তারা গরমের সময় জানলা খুলে শুয়েছে‌, তুমি যেন তাদের জানলা দিয়ে গ্রহ-তারা দেখতে যেও না।’

কপিল মুখের ওপর হাত চাপা দিয়ে হাসল‌, বলল–’বউদি‌, তোমার মনটা ভারি সন্দিগ্ধ। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞেস করি‌, তুমি এত রাত্রি পর্যন্ত ঘুমোওনি কেন?’

রমলা বলল–’তোমার দাদা বিছানায় শুয়ে আইনের বই পড়ছেন‌, হঠাৎ তাঁর কফি খাবার শখ হল। তাই কফি তৈরি করতে চলেছি। তুমি খাবে?

‘আমার সময় নেই।’ কপিল চুপি চুপি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল।

হয়তো মঙ্গলগ্রহই দেখবে।

আর একটি রাত্রির কথা :

সিনেমার শিল্পক্ষেত্রে যারা কাজ করে তারা সাধারণত দল বেঁধে থাকে‌, নিজেদের শিল্পীগোষ্ঠী নিয়ে একটা সমাজ তৈরি করে নিয়েছে‌, বাইরের লোকের সঙ্গে বড় একটা সম্পর্ক রাখে না। সুজন মিত্র কিন্তু দলে থেকেও ঠিক দলের পাখি নয়। যতক্ষণ সে স্টুডিওর সীমানার মধ্যে থাকে ততক্ষণ সকল শ্রেণীর সহকর্মী ও সহকর্মিণীর সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করে। তরুণী অভিনেত্রীদের মধ্যে অনেকেই এই সুদৰ্শন নবেদিত অভিনেতাটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল‌, কিন্তু সুজন কারুর কাছে ধরা দেয়নি। পাঁকাল মাছের মত হাত পিছলে বেরিয়ে যাবার কৌশল তার জানা ছিল।

সিনেমার গণ্ডীর বাইরে তার প্রধান বন্ধুগোষ্ঠী ছিল নৃপতির আড়ার ছেলেরা; এখানে এসে সে যেন সমভূমিতে পদার্পণ করত। তার বংশপরিচয় কেউ জানে না‌, তার জ্ঞাতিগোষ্ঠী কেউ আছে কিনা সে পরিচয়ও কেউ কোনো দিন পায়নি‌, কিন্তু তার বন্ধু-নিবাঁচন থেকে অনুমান করা যায় যে তার বংশপরিচয় যেমনই হোক‌, সে নিজে উচ্চ-মধ্যম ত্ৰৈণীর শিক্ষিত মার্জিত চরিত্রের মানুষ।

একদিন স্টুডিওতে তার শুটিং ছিল‌, কাজ শেষ হতে সন্ধ্যে পেরিয়ে গেল। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে মুখের রঙ পরিষ্কার করে বেরুতে আরো ঘণ্টাখানেক কাটল। সুজনের একটি ছোট মোটর আছে‌, তাইতে চড়ে সে যখন স্টুডিও থেকে বেরুল তখন রাত্রি হয়ে গেছে।

মাইল দেড়েক চলাবার পর মোটর একটি হোটেলের সামনে এসে থামল। সুজন হোটেলেই। খায়। তার বাসায় রান্নার আয়োজন নেই। কিন্তু রোজ একই হোটেলে খায় না। যখন যা খাবার ইচ্ছে হয় তখন সেই রকম হোটেলে যায়‌, কখনো বা মিষ্টান্নের দোকানে গিয়ে দই-সন্দেশ খেয়ে পেট ভরায়। যেদিন শুটিং থাকে সেদিন দুপুরে স্টুডিওর ক্যান্টিনে খায়।

হোটেলের পাশে গাড়ি পার্ক করে সে যখন হোটেলে ঢুকাল তখন তার নাকের নীচে একজোড়া শৌখিন গোঁফ শোভা পাচ্ছে। গোঁফ জোড়া অকৃত্রিম নয়‌, সুজন কোনো প্রকাশ্য স্থানে গেলেই মুখে গোঁফ লাগিয়ে ছদ্মবেশ পরিধান করে। তার মুখখানা সিনেমার প্রসাদে জনসাধারণের খুবই পরিচিত‌, তাকে সশরীরে দেখলে সিনেমা-পাগল লোকেরা বিরক্ত করবে। এই আশঙ্কাতেই হয়তো সে গোঁফের আড়ালে স্বরূপ লুকিয়ে রাখে।

হোটেলে আহার শেষ করে সুজন মোটর চালিয়ে নিজের বাসার দিকে চলল। বাসাটি পাড়ার এক প্রান্তে একটি সরু রাস্তার ওপর; ছোট বাড়ি কিন্তু গাড়ি রাখার আস্তাবল আছে।

গ্যারেজে গাড়ি রেখে সুজন চাবি দিয়ে দরজা খুলে বাড়িতে ঢুকল, ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে শোবার ঘরে গিয়ে আলো জ্বালল। একসঙ্গে গোটা তিনেক দ্যুতিমান বালব জ্বলে উঠল।

চৌকশ ঘরটি বেশ বড়। তাতে খাট-বিছানা আছে‌, টেবিল-চেয়ার আলমারি আছে‌, এমন কি স্টেভি‌, চায়ের সরঞ্জাম প্রভৃতিও আছে। মনে হয়‌, সুজন এই একটি ঘরের মধ্যে তার একক জীবনযাত্রার সমস্ত উপকরণ সঞ্চয় করে রেখেছে।

একটি লম্বা আরাম-কেদারায় অঙ্গ ছড়িয়ে দিয়ে সে পকেট থেকে সিগারেট বার করল‌, সিগারেট ধরিয়ে পিছনে মাথা হেলিয়ে দিয়ে উজ্জ্বল একটা বালবের দিকে দৃষ্টি রেখে মৃদ-মন্দ টান দিতে লাগল। এখন আর তার মুখে গোঁফ নেই‌, নগ্ন মুখখান ছুরির মত ধরাল।

সিগারেট শেষ করে সুজন কব্জির ঘড়ি দেখল-নাটা বেজে কুড়ি মিনিট। সে উঠে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল; সাড়ে ছফুট উঁচু আয়নায় তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। সে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে নিজের দেহ মুখ পরীক্ষা করল; একবার হাসল‌, একবার ভ্রূকুটি করল‌, তারপর আড়মোড়া ভেঙে আলমারির কাছে গেল।

আলমারি থেকে সে দু’টি জিনিস বার করল; একটি হুইস্কির বোতল এবং বড় চৌকো। আকারের একটি পুরু। লাল কাগজের খাম। প্রথমে সে গেলাসে ছোট পেগ মাপের হুইস্কি ঢেলে তাতে জল মেশালো‌, তারপর গেলাস আর খাম নিয়ে আবার চেয়ারে এসে বসল। গেলাসে ছোট একটি চুমুক দিয়ে চেয়ারের হাতার ওপর রেখে আগফার খাম থেকে একটি ফটো বার করল।

ক্যাবিনেট আয়তনের ফটো‌, একটি যুবতীর আ-কটি প্রতিকৃতি‌, যুবতী হাসি-হাসি মুখে দর্শকের পানে চেয়ে আছে। মনে হয়‌, সে সিনেমার অভিনেত্রী নয়‌, মুখে বা দেহভঙ্গীতে কৃত্রিমতা নেই। কিন্তু সে কুমারী কি বিবাহিতা‌, ফটো থেকে বোঝা যায় না।

সুজন থেকে থেকে গেলাসে চুমুক দিতে দিতে ছবিটি দেখতে লাগল। চোখে তার প্রগাঢ় তন্ময়ত‌, পলকের তরেও ছবি থেকে চোখ সরাতে পারছে না। এক ঘণ্টা কেটে গেল‌, গোলাসের পানীয় নিঃশেষ হল; কিন্তু সুজনের চিত্রদর্শন-পিপাসা মিটাল না। সে ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে আবার সিগারেট ধরল। তার ঠোঁট নড়তে লাগল‌, যেন চুপি চুপি ছবির সঙ্গে কথা কইছে। তারপর ছবিটি নিজের গালের ওপর চেপে ধরে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল।

50 Shares