শজারুর কাঁটা

‘খবর সব ভাল?’

‘হ্যাঁ।’

‘তোমার স্বামী কোনো গোলমাল করেনি?’

‘না।‘

‘তুমি যেমন ছিলে তেমনি আছ?’

‘হাঁ।’

‘আমার নাম কাউকে বলনি?’

‘না।‘

‘মা কালীর নামে দিব্যি করেছ‌, মনে আছে?’

‘আছে।’

‘আচ্ছা‌, আজ এই পর্যন্ত। সাবধানে থেকে। আবার টেলিফোন করব।’

দীপার মুখ দিয়ে আর কথা বেরুল না‌, সে টেলিফোন রেখে আবার এসে বসল; মনে হল‌, তার দেহের সমস্ত প্রাণশক্তি ফুরিয়ে গেছে। দুহাতে মুখ ঢেকে সে চেয়ারে পড়ে রইল।

সাড়ে ন’টার সময় নকুল আকার এসে বলল—বউদি‌, দাদাবাবু এখনো এল না‌, আমার ভাল ঠেকছে না—‘

এই সময় তৃতীয় বার টেলিফোন বাজল। দীপার মুখ সাদা হয়ে গেল; সে সমস্ত শরীর শক্ত করে উঠে গিয়ে ফোন ধরল। মেয়েলী গলার আওয়াজ শুনল–’হ্যালো‌, এটা কি দেবাশিস ভট্টের বাড়ি?’

দীপার বুক ধড়ফড় করে উঠল‌, সে কোনো মতে উচ্চারণ করল—’হ্যাঁ।’

‘আপনি কি তাঁর স্ত্রী?’

‘হ্যাঁ।’

‘দেখুন‌, আমি হাসপাতাল থেকে বলছি। আপনি একবার আসতে পারবেন?’

‘কেন? কী হয়েছে?’

‘ইয়ে-আপনার স্বামীর একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে‌, তাঁকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। আপনি চট্‌ করে আসুন।’

দীপার মুখ থেকে বুক-ফাটা প্রশ্ন বেরিয়ে এল—’বেঁচে আছেন?’

‘হ্যাঁ। এই কিছুক্ষণ আগে জ্ঞান হয়েছে।’

‘আমি এক্ষুনি যাচ্ছি। কোন হাসপাতাল?’

‘রাসবিহারী হাসপাতাল‌, এমারজেন্সি ওয়ার্ড।’

ফোন রেখে দিয়ে দীপা ফিরল; দেখল‌, নকুল তাঁর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। নকুল ব্যাকুল চোখে চেয়ে বলল–’বউদি?

নকুলের শঙ্কা-বিবশ মুখ দেখে দীপা হঠাৎ নিজের হৃদয়টাও দেখতে পেল। আজকের দীপা আর দু’ মাস আগের দীপা নেই‌, সব ওলট-পালট হয়ে গেছে। তার মাথাটা একবার ঘুরে উঠল। তারপর সে দৃঢ়ভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল—’তোমার দাদাবাবুর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে‌, তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।’

নকুল আস্তে আস্তে মেঝের ওপর বসে পড়ল। দীপা বলল—’না নকুল‌, এ সময় ভেঙে পড়লে চলবে না। চল‌, এক্ষুনি হাসপাতালে যেতে হবে।’

দীপা নকুলকে হাতে ধরে টেনে দাঁড় করালো।

অনুক্রম

ব্যোমকেশকে নিয়ে রাখালবাবু যখন হাসপাতালে পৌঁছুলেন তখন রাত্রি দশটা। হাসপাতালের দর দালানে লোক কমে গেছে। এক পাশে এক বেঞ্চিতে একটি যুবতী শরীর শক্ত করে বসে। আছে‌, তার পায়ের কাছে জবুথবু হয়ে বসে আছে একটি বুড়ে চাকর। যুবতীর চোখে বিভীষিকাময় সম্ভাবনার আতঙ্ক।

একটি নার্স ব্যোমকেশকে দেখে এগিয়ে এল। রাখালবাবু বললেন—’থানা থেকে আসছি।’

‘আসুন।’ নার্স তাঁদের ভিতরে নিয়ে গিয়ে একটি ঘরে বসাল। বলল—‘একটু বসুন‌, ডাক্তার গুপ্ত আপনাদেরই জন্য অপেক্ষা করছেন।’

নার্স চলে গেল। অল্পক্ষণ পরে ডাক্তার গুপ্ত এলেন। মধ্যবয়স্ক মধ্যমাকৃতি মানুষ‌, বিশ বছর ধরে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করেও ক্লান্ত হননি‌, বরং প্রাণশক্তি আরো বেড়েছে। রাখালবাবু নিজের এবং ব্যোমকেশের পরিচয় দিলে ডাক্তার হেসে বললেন—’আরে মশাই‌, আজ দেখছি অসাধারণ ঘটনা ঘটার দিন। ব্যোমকেশবাবুর সঙ্গেও পরিচয় হল। বসুন‌, বসুন।’

তিনজন বসলেন। রাখালবাবু বললেন—’ব্যাপার কি বলুন দেখি।’

ডাক্তার গুপ্ত বললেন–’আরো মশাই‌, আশ্চর্য ব্যাপার‌, অভাবনীয় ব্যাপার। আমি বিশ বছর। ডাক্তারি করছি‌, এমন প্রকৃতিবিরুদ্ধ ব্যাপার দেখিনি। অবশ্য ডাক্তারি কেতবে দু-চারটে উদাহরণ পাওয়া যায়। কিন্তু স্বচক্ষে দেখা-কোটিকে গুটিক মিলে।’

ব্যোমকেশ হেসে বলল–’রহস্য নিয়েই আমার কারবার‌, আপনি আমাকেও অবাক করে দিয়েছেন। মনে হচ্ছে‌, একটা মনের মত রহস্য এতদিনে পাওয়া গেছে। আপনি গোড়া থেকে সব কথা বলুন।’

ডাক্তার বললেন–’বেশ‌, তাই বলছি। আজ রাত্রি সাড়ে আটটার সময় তিনটি ছোকরা একজন অজ্ঞান লোককে ট্যাক্সিতে নিয়ে এখানে এল। তারা রবীন্দ্র সরোবরে বেড়াতে গিয়েছিল‌, দেখল একটা গাছের তলায় বেঞ্চির পাশে মানুষ পড়ে আছে। দেশলাই জ্বেলে মানুষটাকে দেখল‌, তার পিঠের বাঁ দিকে শজারুর কাঁটা বিঁধে আছে। লোকটা কিন্তু মরেনি‌, অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। ওদের মধ্যে একজন লোকটিকে চিনতে পারল‌, তাদের ফ্যাক্টরির মালিক দেবাশিস ভট্ট। তখন তারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে এল।

‘ছোকরাকে টেবিলে শুইয়ে পরীক্ষা করলাম। শজারুর কাঁটা দিয়ে হত্যা করার কথা সবাই জানে; আমি ভাবলাম এ ক্ষেত্রে কাঁটা বোধ হয়। হার্ট পর্যন্ত পৌঁছয়নি। কিন্তু হার্ট পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখি–অবাক কাণ্ড। হার্ট নেই! তারপর বুকের ডান দিকে হার্ট খুঁজে পেলাম। প্রকৃতির খেয়ালে ছোকরা ডান দিকে হার্ট নিয়ে জন্মেছে।

‘শজারুর কাঁটা হার্টকে বিধতে পারেনি বটে‌, কিন্তু বাঁ দিকের ফুসফুসে বিঁধেছে। সেটাও কম সিরিয়াস নয়। যতক্ষণ কাঁটা বিধে আছে‌, ততক্ষণ রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে না‌, কিন্তু কাঁটা বার করলেই ফুসফুসের মধ্যে রক্তপাত হয়ে মৃত্যু হতে পারে।

‘যাহোক‌, খুব সাবধানে পিঠ থেকে কাঁটা বার করলাম। ছ’ ইঞ্চি লম্বা কাঁটা‌, তার দুইঞ্চি বাইরে বেরিয়ে ছিল‌, বাকিটা সোজা ফুসফুসের মধ্যে ঢুকেছিল। এই দেখুন সেই কাঁটা।’

ডাক্তার পকেট থেকে একটি শজারুর কাঁটা বার করে ব্যোমকেশের হাতে দিলেন। শজারুর কাঁটা অনেকেই দেখেছেন‌, সবিস্তারে বর্ণনার প্রয়োজন নেই। এই কাঁটাটি নিরুনের মত সরু‌, কাচের কাঠির মত অনমনীয় এবং ডাক্তারি শল্যের মত তীক্ষ্ণগ্র। মারাত্মক অস্ত্রটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে ব্যোমকেশ রাখালবাবুর হাতে দিল‌, বলল—’তারপর বলুন।’

50 Shares