দেয়ালের ঘড়িতে ঠুং ঠুং করে পাঁচটা বাজল। দীপার চোখ দু’টি অমনি খুলে গেল; সে ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে রেডিও বন্ধ করে দিল, তারপর উঠে বাইরের দরজার দিকে চলল। দরজা খুলতেই সামনে সিঁড়ি নেমে গেছে। দীপা সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে সামনের দিকে ঝুকে ডাকল-নকুল।’
নকুল বাড়ির একমাত্র চাকর এবং পাচক, সাবেক কাল থেকে আছে। সে একতলার খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে উঁচু দিকে চেয়ে বলল—’হ্যাঁ বউদি, দাদাবাবুর জলখাবার তৈরি আছে।’
দীপা তখন গায়ের শিথিল কাপড়-চোপড় গুছিয়ে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁচেছে এমন সময় কিড়িং কিড়িং শব্দে সদর দরজার ঘন্টি বেজে উঠল।
দীপা গিয়ে দোর খুলে দিল। কোট-প্যান্ট পরা দেবাশিস প্রবেশ করল। দু’জনে দু’জনের মুখের পানে তাকাল কিন্তু তাদের মুখে হাসি ফুটল না। এদের জীবনে হাসি সুলভ নয়। দীপা নিরুৎসুক সুরে বলল—’জলখাবার তৈরি আছে।’
দেবাশিস কণ্ঠস্বরে শিষ্টতার প্রলেপ মাখিয়ে বলল–’বেশ, বেশ, আমি জামাকাপড় বদলে এখনই আসছি।’
সে তরতার করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল। দীপা মন্থর পদে খাবার ঘরে গিয়ে টেবিলের এক পাশে বসিল।
লম্বাটে ধরনের খাবার টেবিল; চারজনের মত জায়গা, গাদাগাদি করে ছ’জন বসা চলে। দীপা এক প্রান্তে বসে দেখতে লাগল, নকুল দু’টি প্লেটে খাবার সাজাচ্ছে; লুচিভাজা, আলুর দম, বাড়িতে তৈরি সন্দেশ। নকুল মানুষটি বেঁটে-খাটো, মাথার চুল পেকেছে, কিন্তু শরীর বেশ নিটোল। বেশি কথা কয় না, কিন্তু চোখ দু’টি সতর্ক এবং জিজ্ঞাসু। দীপা তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবতে লাগল-নকুল নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে। তবু নকুলের সামনে ধোঁকার টাটি সুড় রাখতে হয়। শুধু নকুল কেন, পৃথিবীসুদ্ধ লোকের সামনে। বিচিত্র তাদের বিবাহিত ধুতি পাঞ্জাবি পরে দেবাশিস নেমে এল। একহারা দীঘল চেহারা, ফস সুশ্ৰী মুখ; বয়স সাতাশ কি আটাশ। সে টেবিলের অন্য প্রান্তে এসে বসতেই নকুল খাবারের প্লেট এনে তার সামনে রাখল, দীপার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে বলল–’তোমাকেও দেব নাকি বউদি?
দীপা মাথা নেড়ে বলল–’না, আমি পরে খাব।’ দেবাশিসের সঙ্গে একসঙ্গে খাওয়া এখনো তার অভ্যাস হয়নি; তার বাপের বাড়িতে অন্য রকম রেওয়াজ, পুরুষদের খাওয়া শেষ হলে তবে মেয়েরা খেতে বসে। দীপা সহজে অভ্যাস ছাড়তে পারে না; তবু রাত্রির আহারটা দু’জনে টেবিলের দু’ প্রান্তে বসে সম্পন্ন করে। নইলে নকুলের চোখেও বড় বিসদৃশ দেখাবে।
কিছুক্ষণ কোনো কথাবার্তা নেই; দেবাশিস একমনে লুচি, আলুর দাম খাচ্ছে; দীপা যা-হোক একটা কোনো কথা বলতে চাইছে কিন্তু কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। পিছন থেকে নকুলের সতর্ক চক্ষু তাদের লক্ষ্য করছে।
শেষ পর্যন্ত দেবাশিসই প্রথম কথা কইল, সোজা হয়ে বসে দীপার পানে চেয়ে একটু হেসে বলল–’আজ একটা নতুন ক্রিম তৈরি করেছি।’
দেবাশিসের কাজকর্ম সম্বন্ধে দীপা কখনো ঔৎসুক্য প্রকাশ করেনি। কিন্তু এখন সে আগ্রহ দেখিয়ে বলল–’তাই নাকি? কিসের ক্রিম?’
দেবাশিস বলল–’মুখে মাখার ক্রিম।’
‘ও মা, সত্যি? কেমন গন্ধ?’
‘তা আমি কি করে বলব। যারা মাখবে তারা বলতে পারবে।’
‘তা বাড়িতে একটু যদি আনো, আমি মেখে দেখতে পারি।’
দেবাশিস হাসিমুখে মাথা নাড়ল–’তোমার এখন মাখা চলবে না, অন্য লোকের মুখে মাখিয়ে দেখতে হবে মুখে ঘা বেরোয় কিনা। পরীক্ষা না করে বলা যায় না।’
‘কার মুখে মাখিয়ে পরীক্ষা করবে?’
‘ফ্যাক্টরির দারোয়ান ফৌজদার সিং-এর মুখে মাখিয়ে দেখব। তার গালের চামড়া হাতির চামড়ার মত।’
দীপার মুখে হাসি ফুটল; সে যে নকুলের সামনে অভিনয় করছে তা ক্ষণকালের জন্যে বিস্মরণ হয়েছিল, দেবাশিসের মুখের হাসি তার মুখে সংক্রামিত হয়েছিল।
আহার শেষ করে দেবাশিস উঠল। দু’জনে খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির নীচে এসে দাঁড়াল। দেবাশিস হঠাৎ আগ্রহভরে বলল–’দীপা, আজ উৎপলা সিনেমাতে একটা ভাল ছবি দেখাচ্ছে। দেখতে যাবে?
দেবাশিস আগে কখনো দীপকে সিনেমায় নিয়ে যাবার প্রস্তাব করেনি; দীপার শরীরের ভিতর দিয়ে একটা বৈদ্যুতিক শিহরণ বয়ে গেল। তারপরই তার মন শক্ত হয়ে উঠল। সে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল-না, আমি যাব না।’
দেবাশিসের মুখ স্নান হয়ে গেল, তারপর গভীর হয়ে উঠল। সে কিছুক্ষণ দীপার। পানে চেয়ে থেকে বলল–’ভয় নেই, সিনেমা-ঘরের অন্ধকারে আমি তোমার গায়ে হাত দেব না।’
আবার দীপার শরীর কেঁপে উঠল, কিন্তু সে আরো শক্ত হয়ে বলল—’না, সিনেমা আমার ভাল লাগে না।’ এই বলে সে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। দেবাশিস ওপর দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বলল–’আমি নৃপতিদার বাড়িতে যাচ্ছি, ফিরতে সাড়ে আটটা হবে।’
সদর দরজা খুলে দেবাশিস বাইরে এল, দোরের সামনে তার ফিয়েট গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে; কাজ থেকে ফিরে এসে সে গাড়িটা দোরের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। ভেবেছিল, সিনেমা দেখতে যাবার প্রস্তাব করলে দীপা অমত করবে না। তার মন সহজে তিক্ত হয় না, আজ কিন্তু তার মন তিক্ত হয়ে উঠল। এতটুকু বিশ্বাস দীপা তাকে করতে পারে না! এই দু’ মাস দীপ তার বাড়িতে আছে, কোনো দিন কোনো ছুতোয় সে দীপার গায়ে হাত দেয়নি, নিজের দাম্পত্য অধিকার জারি করেনি। তবে আজ দীপা তাকে এমনভাবে অপমান করল কেন?
দেবাশিস গাড়ির চালকের আসনে বসে গাড়িতে স্টার্ট দিল। বাড়ির পিছন দিকে গাড়ি রাখার ঘর, সেখানে গাড়ি রেখে সে পায়ে হেঁটে বেরুল। নৃপতি লাহার বাড়ি পাঁচ মিনিটের রাস্তা। নৃপতির বৈঠকখানায় রোজ সন্ধ্যার পর আড্ডা বসে, দেবাশিস প্রায়ই সেখানে যায়।