শজারুর কাঁটা

ডাক্তার বললেন–’কাঁটা বার করলাম। ছোকরার বরাত ভাল ফুসফুসের মধ্যে রক্তপাত হল না। কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান হল‌, নিজের ঠিকানা ও ফোন নম্বর দিয়ে স্ত্রীর কাছে খবর পাঠাতে বলল। তারপর তাকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়ালাম। ওর স্ত্রী যখন এল তখন ও ঘুমুচ্ছে।’

ব্যোমকেশ বলল–’বাইরে একটি মেয়ে বসে আছে‌, সেই কি-?’

ডাক্তার বললেন-’হ্যাঁ, দেবাশিসের স্ত্রী। ও স্বামীর কাছে থাকতে চায়‌, কিন্তু এখন তো তা সম্ভব নয়। ওকে বললাম‌, বাড়ি ফিরে যাও; কিন্তু ও যাবে না।’

‘ওকে স্বামীর কাছে যেতে দেওয়া হয়েছিল?’

‘একবার ঘরে গিয়ে স্বামীকে দেখে এসেছে। আমরা আশ্বাস দিয়েছি‌, আশঙ্কার বিশেষ কারণ নেই‌, তুমি বাড়ি যাও‌, কাল সকালে আবার এস। কিন্তু ও কিছুতেই যাবে না।’

ব্যোমকেশ উঠবার উপক্রম করে বলল–’আচ্ছা‌, আমি একবার চেষ্টা করে দেখি।’

ডাক্তার বললেন–বেশ তো‌, দেখুন না। কিন্তু একটা কথা। ওর স্বামীকে কেউ খুন করবার চেষ্টা করেছিল একথা ওকে বলা হয়নি‌, বলা হয়েছে অ্যাকসিডেন্টে বুকে চোট লেগেছে। আপনারাও তাই বলবেন। মেয়েটি এমনিতেই শক্‌ পেয়েছে‌, ওকথা শুনলে আরো বেশি শক পাবে।’

‘না‌, বলব না।’

রাখালবাবু বললেন-‘শজারুর কাঁটা আমি রাখলাম। এই নিয়ে চারটি হল।’

দীপা বেঞ্চির ওপর ঠিক আগের মতাই সোজা হয়ে বসে ছিল‌, ব্যোমকেশ আর রাখালবাবু তার কাছে যেতেই সে উঠে দাঁড়াল। রাখালবাবু বললেন—’আমি পুলিসের লোক। ইনি শ্ৰীব্যোমকেশ বক্সী।’

ব্যোমকেশের নাম দীপার মনে কোনো দাগ কাটল না। তার শঙ্কাভরা চোখ একবার এর মুখে একবার ওর মুখে যাতায়াত করতে লাগল।

ব্যোমকেশ নরম সুরে বলল–’আপনি ভয় পাবেন না। আপনার স্বামীর গুরুতর আঘাত লেগেছিল বটে‌, কিন্তু জীবনের আশঙ্কা আর নেই।’

দীপা দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে বোধ করি নিজেকে সংযত করল। তারপর ভাঙা-ভাঙা গলায় বলল–’আমাকে ওঘরে থাকতে দিচ্ছে না কেন?’

ব্যোমকেশ বলল–’দেখুন‌, আপনার স্বামীকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে‌, এ সময় আপনি তাঁর কাছে থেকে কী করবেন? তার চেয়ে–’

দীপা বলল–’না‌, আমাকে যদি ওর কাছে থাকতে না দেওয়া হয়‌, আমি সারা রাত্রি এখানে বসে থাকব।’

ব্যোমকেশ বলল–’কিন্তু রুগীর ঘরে ডাক্তার আর নার্স ছাড়া এসময় অন্য কারুর থাকা নিষেধ।’

দীপা বলল—’আমি কিছু করব না‌, খাটের একপাশে চুপটি করে বসে থাকব।’

ব্যোমকেশ আরো কিছুক্ষণ দীপাকে বোঝাবার চেষ্টা করল‌, কিন্তু তাকে টলাতে পারল না। তখন সে মাথা চুলকে বলল—’আচ্ছা‌, ডাক্তারবাবুকে বলে দেখি। দেবাশিসবাবুর কি অন্য কোনো আত্মীয় এখানে নেই?’

‘না‌, ওঁর অন্য কোনো আত্মীয় নেই।’

‘আপনার নিশ্চয় আত্মীয়স্বজন আছেন। তাঁরা কোথায় থাকেন‌, তাঁদের খবর দেওয়া হয়েছে?’

দীপা বলল—’তাঁরা কাছেই থাকেন‌, কিন্তু তাঁদের খবর দিতে ভুল হয়ে গেছে।’

ব্যোমকেশ বলল–’ঠিকানা দিন‌, আমরা তাঁদের খবর দিচ্ছি।’

দীপা ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর দিল। ব্যোমকেশ তখন ডাক্তার গুপ্তর কাছে ফিরে গিয়ে বলল—’ডাক্তারবাবু্‌, বউটিকে স্বামীর কাছে থাকতে দিন। ও বুদ্ধিমতী বলেই মনে হল‌, কিন্তু বড় ভয় পেয়েছে।‘

ডাক্তারবাবু দু’ একবার আপত্তি করলেন‌, স্ত্রীজাতি বড় ভাবপ্রবণ‌, আবেগের বশে যদি স্বামীকে আঁকড়ে ধরে‌, ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত তিনি রাজী হলেন। ব্যোমকেশ দীপাকে ডেকে এনে যে ঘরে দেবাশিস ছিল সেই ঘরে নিয়ে গেল। দীপা পা টিপে টিপে গিয়ে খাটের পাশে দাঁড়াল‌, সামনের দিকে ঝুকে ব্যগ্র চোখে দেবাশিসের মুখ দেখল। দেবাশিস পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমোচ্ছে‌, তার মুখের ভাব শান্ত প্রসন্ন। দীপা তার মুখের ওপর চোখ‌, রেখে অতি সন্তৰ্পণে খাটের পাশে বসল। একজন নার্সও সঙ্গে এসেছিল‌, সে ঠোঁটে আঙুল রেখে দীপাকে সতর্ক করে দিল।

রাত্রি এগারোটার সময় হাসপাতাল থেকে বেরুবার পথে রাখালবাবু ব্যোমকেশের পানে চাইলেন–’বউটির বাপের বাড়িতে টেলিফোন করতে হবে।’

ব্যোমকেশ বলল–’না‌, সশরীরে সেখানে উপস্থিত হওয়া দরকার। আজ রাত্রে তোমার বিশ্রাম নেই।’

রাখালবাবু বললেন–’আমি বিশ্রামের জন্যে ব্যস্ত নই।’

পুলিসের গাড়িতে দীপার বাপের বাড়িতে পৌঁছুঁতে পাঁচ মিনিটও লাগল না। রাস্তা নিরালা‌, বাড়ির সদর দোর বন্ধ। রাখালবাবু সজোরে কড়া নাড়লেন।

কিছুক্ষণ পরে বিজয় ঘুম-চোখে দরজা একটু ফাঁক করে বলল—’কে? কি চাই?’

রাখালবাবু বলল—’ভয় নেই‌, দোর খুলুন। আমরা পুলিসের লোক।’

ইতিমধ্যে নীলমাধব উপস্থিত হয়েছেন। বিজয় দোর খুলে দিল‌, রাখালবাবু ব্যোমকেশকে নিয়ে ভিতরে এসে প্রশ্ন করলেন–’দেবাশিস ভট্ট আপনাদের কে?’

নীলমাধব বললেন—’আমার জামাই। কি হয়েছে?’

রাখালবাবু বললেন—’একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে‌, আপনার জামাই বুকে আঘাত পেয়ে হাসপাতালে আছেন। আপনার মেয়েও খবর পেয়ে সেখানে গিয়েছেন।’

নীলমাধব বললেন—’অ্যাঁ! কোন হাসপাতালে?’

‘রাসবিহারী হাসপাতালে। ভয় পাবেন না আঘাত গুরুতর হলেও জীবনের আশঙ্কা নেই।’

‘আমরা এখনি যাচ্ছি। বিজয়‌, তুমি এদের বসাও‌, আমি তোমার মাকে নিয়ে যাচ্ছি।’

তিনি ছুটে বাড়ির ভিতর চলে গেলেন। ব্যোমকেশ বিজয়কে প্রশ্ন করল—’দেবাশিসবাবু আপনার ভগিনীপতি?

‘হ্যাঁ। আমিও হাসপাতালে যাব।’

‘না আপনার সঙ্গে আমাদের একটু আলোচনা আছে।’

খানিক পরে নীলমাধব আধ-ঘোমটা টানা স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। রাখালবাবু বললেন—’আপনারা পুলিসের গাড়িতেই যান। গাড়ি আপনাদের পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসবে। ততক্ষণ আমরা এখানেই আছি।’

50 Shares