শজারুর কাঁটা

তাঁদের রওনা করে দিয়ে তিনজনে বৈঠকখানায় এসে বসলেন। ব্যোমকেশ বিজয়কে প্রশ্ন করল–’আপনার বোনের কত দিন বিয়ে হয়েছে?’

বিজয় বলল-‘দু’মাসের কিছু বেশি।’

‘আপনার ভগিনীপতি কি কাজ করেন?’

বিজয় ‘প্রজাপতি প্রসাধন ফ্যাক্টরির কথা বলল।

‘তাঁর আত্মীয়স্বজন কেউ নেই?’

‘যতদূর জানি‌, কেউ নেই!’

‘বন্ধুবান্ধব?’

‘অন্য বন্ধুবান্ধবের কথা জানি না‌, কিন্তু নৃপতিদার আড্ডায় যারা যায়। তাদের সঙ্গে দেবাশিসের ঘনিষ্ঠতা আছে।’ নৃপতি লাহার আডার পরিচয় দিয়ে বিজয় বলল—’কিন্তু এসব প্রশ্ন কেন?’

ব্যোমকেশ একবার রাখালবাবুর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করে বলল—’আপনাকে বলছি‌, আপনি উপস্থিত অন্য কাউকে বলবেন না‌, দেবাশিসবাবুকে কেউ খুন করবার চেষ্টা করেছিল।’

বিজয়ের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল‌, সে উত্তেজিত হয়ে বলল–’আমি জানতাম।’

ব্যোমকেশের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল—’কী জানতেন?

‘জানতাম যে‌, এই ঘটবে।’

‘জানতেন এই ঘটবে! কী জানতেন সব কথা বলুন।’

উত্তেজনার ঝোঁকে কথাটা বলে ফেলেই বিজয় থমকে গেল। আর কিছু বলতে চায় না‌, এ-কথা সে-কথা বলে আসল কথাটা চাপা দিতে চায়। ব্যোমকেশ তখন গম্ভীরভাবে বলল–’দেখুন‌, দেবাশিসবাবুর শত্ৰু তাঁকে খুন করবার চেষ্টা করেছিল‌, দৈবক্রমে তাঁর প্রাণ বেঁচে গেছে। আপনি যদি আসামীকে আড়াল করবার চেষ্টা করেন তাহলে সে আবার চেষ্টা করবে। আপনি কি চান‌, আপনার বোন বিধবা হন?’

তখন বিজয় বলল–’আমি যা জানি বলছি। কিন্তু কে আসামী‌, আমি জানি না।’

বিজয় দীপার প্ৰেম কাহিনী শোনাল। শুনে ব্যোমকেশ একটু চুপ করে রইল‌, তারপর বলল–’মনে হয়‌, আপনার বোনের ছেলেমানুষী ভালবাসার নেশা কেটে গেছে। আচ্ছা‌, আজ আমরা উঠলাম। কাল বিকেলবেলা আমরা নৃপতিবাবুর বাড়িতে যাব। আপনিও উপস্থিত থাকবেন।’

ইতিমধ্যে পুলিসের গাড়ি ফিরে এসেছিল। ব্যোমকেশ গাড়িতে উঠে রাখালবাবুকে বলল–’আজ এই পর্যন্ত। কাল সকালে আবার হাসপাতালে যাব।’

হাসপাতালে রাত্রি আড়াইটের সময় দেবাশিসের ঘুম ভাঙল। চোখ চেয়ে দেখল‌, একটি মুখ তার মুখের পানে ঝুঁকে অপলক চেয়ে আছে। ভারি মিষ্টি মুখখানি। দেবাশিস আস্তে আস্তে বলল–’দীপা‌, কখন এলে?’

দীপা উত্তর দিতে পারল না‌, দেবাশিসের কপালে কপাল রেখে চুপ করে রইল।

‘দীপা।‘

‘উঁ।‘

‘ক্ষিদে পেয়েছে।’

দীপা ত্ররিত মাথা তুলল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল‌, নার্স ঘরে প্রবেশ করেছে। নার্স ইতিপূর্বে আরো কয়েকবার ঘরে এসে রুগীকে দেখে গেছে। বলল–’কি খবর? ঘুম ভেঙেছে?’

দীপা বলল—’হ্যাঁ। বলছেন‌, ক্ষিদে পেয়েছে।’

নার্স হেসে বলল–’বেশ। আমি ওভালটিন তৈরি করে রেখেছি‌, এখনি আনছি। আগে একবার নাড়িটা দেখি।’ নাড়ি দেখে নার্স বলল–’চমৎকার। আমি এই এলুম বলে।’

নার্সের সঙ্গে সঙ্গে দীপা দোর পর্যন্ত গেল। নকুল তখনো দোরের পাশে বসেছিল‌, উঠে দাঁড়াল। বলল—’বউদি‌, দাদাবাবু খেতে চাইছে?’

দীপা বলল—’হ্যাঁ।’

‘জয় জগদীশ্বর! তাহলে আর ভয় নেই। বউদি‌, তুমিও তো কিছু খাওনি। তোমার ক্ষিদে পায়নি?’

দীপা একটু চুপ করে থেকে বলল–’পেয়েছে। নকুল‌, তুমি বাড়ি যাও। নিজে খেয়ো‌, আর আমার জন্যে কিছু নিয়ে এস।’

‘আচ্ছা বউদি।‘

নকুল চলে গেল। নার্স ফীডিং কাপে ওভালটিন এনে দেবাশিসকে খাওয়াল। তারপর দেবাশিস তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে দীপার একটি হাত মুঠির মধ্যে নিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

ভোর হলে দীপার মা বাবা বিজয় সকলে আবার এলেন। দেবাশিস তখন ঘুমোচ্ছে। দীপার মা দীপাকে বললেন–’দীপা‌, আমরা এখানে আছি‌, তুই বাড়ি যা‌, সেখানে স্নান করে একটু কিছু মুখে দিয়ে আবার আসিস।’

নেড়ে বলল—’না। নকুল আমার জন্যে খাবার এনেছিল‌, আমি খেয়েছি।‘

বেলা আন্দাজ দশটার সময় ব্যোমকেশকে নিয়ে রাখালবাবু হাসপাতালে এলেন। ডাক্তার গুপ্ত একগাল হেসে বললেন–’ভাল খবর। ছোকরা এ যাত্রা বেঁচে গেল। সকালে বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। তবু এখনো অন্তত দুতিন দিন হাসপাতালে থাকতে হবে।’

রাখালবাবু বললেন–’ভাল। আমরা তাহলে তার সঙ্গে দেখা করতে পারি?’

ডাক্তার বললেন–’পারেন। কিন্তু দশ মিনিটের বেশি নয়।’

ব্যোমকেশ বলল–’আপাতত দশ মিনিটই যথেষ্ট।’

দেবাশিস তখন পাশ ফিরে বিছানায়‌, শুয়ে ছিল‌, আর দীপা তার মুখের কাছে ঝুকে চুপি চুপি কথা বলছিল। ব্যোমকেশ আর রাখালবাবুকে আসতে দেখে লজ্জিতভাবে উঠে দাঁড়াল।

ব্যোমকেশ স্মিতমুখে দীপাকে বলল—’আপনি কাল থেকে এখানে আছেন‌, এবার অন্তত ঘণ্টাখানেকের জন্যে যেতে হবে। আমরা ততক্ষণ দেবাশিসবাবুর কাছে আছি।’

দেবাশিস ক্ষীণকণ্ঠে বলল–’আমিও তো সেই কথাই বলছি।’

দীপা একটু ইতস্তত করল‌, তারপর অনিচ্ছাভরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল! বলে গেল–’আমি আধা ঘণ্টার মধ্যেই আসব।’

নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললেন—’আমরা আপনাকে দু’চারটি প্রশ্ন করব।’

দেবাশিস বলল–’বেশ তো‌, করুন।’

অতঃপর প্রশ্নোত্তর আরম্ভ হল। ‘আপনি কাল সন্ধ্যের পর লেকে বেড়াতে গিয়েছিলেন?’

‘ঠিক বেড়াতে যাইনি‌, তবে গিয়েছিলাম।’

‘কেন গিয়েছিলেন?’

‘একজন বন্ধু টেলিফোন করে ডেকেছিল।’

‘কে বন্ধু? নাম কি?’

‘খড়্গ বাহাদুর।’

‘খড়্গ বাহাদুর! নেপালী নাকি?’

‘হ্যাঁ। নামকরা ফুটবল খেলোয়াড়।’

‘ও সেই! তা লেকের ধারে ডেকেছিল কেন?’

‘ব্যক্তিগত কারণ। যদি না বললে চলে–’

‘চলবে না। বলুন।’

‘ওর কিছু টাকার দরকার হয়েছিল‌, তাই আমার কাছে ধার চাইবার জন্য ডেকেছিল।’

‘আপনার বাড়িতে আসেনি কেন?’

50 Shares