শজারুর কাঁটা

‘তা জানি না। বোধ হয় বাড়িতে আসতে সঙ্কোচ হয়েছিল‌, যদি কেউ জানতে পারে।’

‘হুঁ। কত টাকা চেয়েছিল?’

‘এক হাজার।’

‘আপনি টাকা নিয়ে গিয়েছিলেন?’

‘না না‌, খড়্গ টেলিফোনে টাকার কথা বলেনি। শুধু বলেছিল জরুরী দরকার আছে।’

‘তারপর?

‘গিয়ে দেখলাম‌, সে বড় ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে আছে; দু’জনে গিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসলাম। খড়্গ টাকার কথা বলল; আমি রাজী হলাম। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর খড়্গ চলে গেল‌, তার অন্য একজনের সঙ্গে দেখা করবার ছিল। আমি একলা বসে রইলাম। হঠাৎ পিঠে দারুণ যন্ত্রণা হল। তারপর আর মনে নেই।’

‘পিছন দিকে কাউকে দেখতে পেয়েছিলেন?’

‘না।‘

রাখালবাবু ব্যোমকেশের পানে তাকালেন। ব্যোমকেশ প্রশ্ন করল–’আপনার হৃৎপিণ্ড যে শরীরের ডান দিকে একথা আপনার স্ত্রী নিশ্চয় জানেন?’

দেবাশিস চোখ বুজে একটু চুপ করে রইল‌, শেষে বলল-‘না‌, ও বোধহয় জানে না।’

‘আপনার বন্ধুরা জানেন?’

‘না‌, আমার বন্ধু বড় কেউ নেই‌, সহকর্মী আছে। সম্প্রতি মাস দুয়েক থেকে আমি নৃপতিদার বাড়িতে যাই‌, সেখানে কয়েকজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে।’

‘নৃপতিবাবুর বাড়ির বন্ধুরা কেউ জানে?’

‘না।‘

‘কেউ জানে না?’

‘বাবা জানতেন আর ডাক্তারবাবুরা জানেন।’

‘এমন কেউ আছে আপনার মৃত্যুতে যার লাভ হবে?’

‘কেউ না।’

‘আচ্ছা‌, আজ আর আপনাকে বেশি প্রশ্ন করব না। আপনি সেরে উঠন‌, তারপর যদি দরকার হয় তখন দেখা যাবে।’

সন্ধ্যের পর নৃপতির ঘরে আড্ডাধারীরা সকলেই উপস্থিত হয়েছিল। বিজয়ও ছিল। সকলের মুখেই উদ্বেগের গাম্ভীর্য। আজ প্রবাল পিয়ানো বাজাচ্ছে না‌, তক্তপোশের ওপর গালে হাত দিয়ে বসে আছে। বিজয়ের মুখে দেবাশিসের কথা শোনার পর সকলেই মুহ্যমান। খবরের কাগজের দুঃসংবাদ হঠাৎ নিজের বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।

প্রবাল মুখ তুলে প্রশ্ন করল–’ব্যোমকেশ বক্সী কে?’

কপিল মুখের একটা ব্যঙ্গ-বঙ্কিম ভঙ্গী করল। বিজয় উত্তর দেবার জন্যে মুখ খুলল। কিন্তু উত্তর দেবার দরকার হল না‌, সদর দরজার বাইরে জুতোর শব্দ শোনা গেল। পরীক্ষণেই ব্যোমকেশকে নিয়ে রাখালবাবু প্রবেশ করলেন।

সকলে উঠে দাঁড়াল। নৃপতি এগিয়ে গিয়ে বলল–’আসুন‌, আমরা আপনাদের জন্যেই অপেক্ষা করছি। আমার নাম নৃপতি লাহা। এঁরা— নৃপতি একে একে কপিল‌, প্রবাল‌, সুজন ও খড়্গ বাহাদুরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল‌, তারপর চেয়ারে বসিয়ে সিগারেট দিল—’বিজয়ের মুখে আমরা সবই শুনেছি।’

ব্যোমকেশ একটু ভর্ৎসনার চোখে বিজয়ের পানে চাইল‌, বিজয় কুষ্ঠিতভাবে বলল—’হ্যাঁ ব্যোমকেশবাবু্‌, এরা ছাড়ল না‌, শজারুর কাঁটার কথা এদের বলেছি।’

খড়্গ বাহাদুর বলল—’আচ্ছা ব্যোমকেশবাবু্‌, এই যে শজারুর কাঁটা নিয়ে ব্যাপার‌, এটা কী? আপনার কি মনে হয়। এসব একটা পাগলের কাজ?’

ব্যোমকেশ বলল–’পাগলের কাজ হতে পারে‌, আবার পাগল সাজার চেষ্টাও হতে পারে।’

সুজন বলল–’সেটা কি রকম?’

ব্যোমকেশ বলল—‘পাগল সাজলে অনেক সময় খুনের দায়ে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। বড় জোর পাগলা গারদে বন্ধ করে রাখে‌, ফাঁসি হয় না‌, এই আর কি। আপনারা দেবাশিসবাবুর বন্ধু‌, তাঁর জীবন সম্বন্ধে নিশ্চয় অনেক কিছু জানেন।’

নৃপতি বলল–’দেবাশিসের সঙ্গে আমাদের পরিচয় বেশি দিনের নয়। আমাদের মধ্যে কেবল প্রবাল তাকে আগে থেকে চিনত।’ বলে প্রবালের দিকে আঙুল দেখাল।

ব্যোমকেশ প্রবালের দিকে চাইল। প্রবাল গলা পরিষ্কার করে বলল–’স্কুলে দেবাশিসের সঙ্গে এক ক্লাসে পড়েছিলাম। তার সঙ্গে পরিচয় ছিল। কিন্তু বন্ধুত্ব ছিল না।’

‘বন্ধুত্ব ছিল না!’

‘বন্ধুত্ব ছিল না‌, অসদ্‌ভাবও ছিল না। তারপর ও পাস করে দিল্লী চলে গেল‌, অনেক দিন দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। মাস দু-এক আগে এই ঘরে তাকে আবার দেখলাম।’

‘ও’—ব্যোমকেশ সিগারেটে দু’তিনটে টান দিয়ে খড়্গ বাহাদুরের দিকে চোখ ফেরাল। বলল—’কাল রাত্রে আন্দাজ আটটার সময় আপনি দেবাশিসবাবুকে টেলিফোন করেছিলেন?’

খড়্গ বাহাদুর বোধহয় প্রশ্নটা প্রতীক্ষ্ণ করছিল‌, সংযত স্বরে বলল—’হ্যাঁ।’

‘কোথা থেকে টেলিফোন করেছিলেন?’

‘এখান থেকে। নৃপতিদার টেলিফোন আছে। আমার সকলেই দরকার হলে ব্যবহার করি। কাল আমরা সকলেই এখানে ছিলাম‌, দেবাশিস ছাড়া। তার আশায় অনেকক্ষণ এখানে অপেক্ষা করলাম। কিন্তু সে যখন এল না। তখন তাকে টেলিফোন করেছিলাম।’

‘তারপর লেকে দেখা হয়েছিল। এখন একটা কথা বলুন দেখি‌, আপনি যখন দেবাশিসবাবুকে ছেড়ে চলে আসেন তখন আশেপাশে কাউকে দেখেছিলেন?’

‘দেখে থাকলেও লক্ষ্য করিনি। আমরা একটা গাছের তলায় বেঞ্চিতে বসেছিলাম। অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল‌, লোকজন বেশি ছিল না।’

ব্যোমকেশ তখন নৃপতিকে বলল–’আপনাকে একটি কাজ করতে হবে। আমরা আপনাদের পৃথকভাবে প্রশ্ন করতে চাই। আমরা একটা ঘরে গিয়ে বসব‌, আর আপনারা একে একে আসবেন। ছোট একটা ঘর পাওয়া যাবে কি?’

নৃপতি বলল–’পাশেই ছোট ঘর আছে‌, আসুন দেখাচ্ছি।’

পরদা-ঢাকা দরজা দিয়ে নৃপতি তাদের পাশের ঘরে নিয়ে গেল। ঘরটি ছোট‌, কয়েকটি চেয়ারের মাঝখানে একটি গোল টেবিল‌, টেবিলের ওপর টেলিফোন যন্ত্র।

ব্যোমকেশ বলল–’এই তো ঠিক যেমনটি চেয়েছিলাম। রাখাল‌, তুমি সভাপতির আসন অলঙ্কৃত কর। নৃপতিবাবু্‌, আপনি বাকি সকলকে বসতে বলে আসুন। আগে আপনার জেরা শেষ করে একে একে ওঁদের ডাকব।’

ছোট্ট ঘরটিতে এজলাস বসল। প্রশ্নোত্তর চলল। চাকর কফি দিয়ে গেল। একে একে সকলে সাক্ষী দিল। সকলের শেষে ঐল বিজয়। ব্যোমকেশ তাকে বলল‌, ‘বিজয়বাবু্‌, আপনার বোনের আইবুড়ো বেলার বই-খাতা জিনিসপত্র নিশ্চয় এখনো আপনাদের বাড়িতে আছে? বেশ। কাল আমরা যাব‌, একটু নেড়েচেড়ে দেখব। যদি দরকারী কিছু পাওয়া যায়।’

50 Shares