শজারুর কাঁটা

বিজয় বলল‌, ‘আচ্ছা।’

অতঃপর সভা ভঙ্গ হল। দশটা বাজতে তখন বেশি দেরি নেই।

পরদিন সকাল আটটার সময় বিজয় নিজেদের বাড়িতে অপেক্ষা করছিল, ব্যোমকেশ আর রাখালবাবু আসতেই তাঁদের দোতলায় দীপার ঘরে নিয়ে গেল। বলল–’এইটে দীপার ঘর। এই ঘরেই তার যা কিছু আছে‌, বিশেষ কিছু নিয়ে যায়নি।’

বেশ বড় ঘর। জানলার পাশে খাট বিছানা‌, অন্য পাশে টেবিল চেয়ার বই-এর আলমারি। পিছনের দেয়ালে একটি এস্রাজ বুলছে। টেবিলের মাঝখানে ছোট্ট একটি জাপানী ট্রানজিস্টার রাখা আছে। ব্যোমকেশ ঘরের চারদিকে একবার সন্ধানী চোখ ফিরিয়ে বলল–’দীপা দেবীর দেখছি গানবাজনার শখ আছে।’

বিজয় বলল—’হ্যাঁ, একটু-আধটু এস্রাজ বাজাতেও জানে। নিজের চেষ্টাতে শিখেছে।’

‘লেখাপড়া কত দূর শিখেছেন?’

‘স্কুলের পড়া শেষ পর্যন্ত পড়েছে। কলেজে দেওয়া হয়নি।’

‘আপনার বাবা বাড়িতে আছেন?’

‘না। বাবা মা হাসপাতালে গেছেন।’

‘দেবাশিসবাবু ভাল আছেন। আমি টেলিফোনে খবর নিয়েছিলাম। বোধহয় দু-তিন দিনের মধ্যেই ছেড়ে দেবে।’

‘হ্যাঁ। আপনারা চা খাবেন?’

ব্যোমকেশ রাখালবাবুর দিকে একবার তাকিয়ে বলল–’আপত্তি কি? একবার হয়েছে‌, কিন্তু অধিকন্তু ন দোষায়।‘

‘আচ্ছা‌, আমি চা নিয়ে আসছি‌, আপনারা দেখুন। বই-এর আলমারির চাবি খুলে দিয়েছি। খাটের তলায় দুটো ট্রাঙ্ক আছে‌, তার চাবিও খোলা।’

বিজয় বেরিয়ে যাবার পর ব্যোমকেশ রাখালবাবুকে বলল–’ঘরে তল্লাশ করার মত বিশেষ কিছু নেই দেখছি। আমি বই-এর আলমারিটা দেখি‌, তুমি ততক্ষণ ট্রাঙ্ক দুটো হাঁটকাও।’

রাখালবাবু খাটের তলা থেকে ট্রাঙ্ক দুটো টেনে বার করলেন‌, ব্যোমকেশ আলমারি খুলে বই দেখতে লাগিল। বইগুলি বেশ পরিচ্ছন্নভাবে সাজানো; প্রথম সারিতে কবিতা আর গানের বই; সঞ্চয়িতা গীতবিতান দ্বিজেন্দ্রগীতি নজরুলগীতিকা প্রভৃতি। দ্বিতীয় থাকে। বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের কয়েক ভলুম গ্রন্থাবলী। নীচের থাকে স্কুল-পাঠ্য বই। দীপা স্কুলে পড়ার সময় যে বইগুলি পড়েছিল সেগুলি যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছে।

ব্যোমকেশ বইগুলি একে একে খুলে দেখল‌, কিন্তু কোথাও এমন কিছু পেল না। যা থেকে কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আধুনিক কোনো লেখকের বই আলমারিতে নেই‌, এমন কি শরৎচন্দ্রের বইও না; এ থেকে পারিবারিক গোঁড়ামির পরিচয় পাওয়া যায়‌, দীপার মানসিক প্রবণতার কোনো ইশারা তাতে নেই।

‘ব্যোমকেশদা‌, একবার এদিকে আসুন।’

ব্যোমকেশ রাখালবাবুর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তিনি একটা খোলা ট্রাঙ্কের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন‌, সামনে মেয়েলী জামাকাপড়ের স্তুপ‌, হাতে পোস্টকার্ড আয়তনের একটি সুদৃশ্য বাঁধানো খাতা। খাতাটি ব্যোমকেশের দিকে এগিয়ে দিয়ে রাখালবাবু বললেন-‘কাপড়-চোপড়ের তলায় ছিল। পড়ে দেখুন।’

অটোগ্রাফের খাতা। বেশির ভাগ পাতাই খালি‌, সামনের কয়েকটি পাতায় উদয়মাধব প্রভৃতি বাড়ির কয়েকজনের হস্তাক্ষর‌, দু-একটি মেয়েলী কাঁচা হাতের নাম দস্তখত। তারপর একটি পাতায় একজনের স্বাক্ষরের ওপর একটি কবিতার ভগ্নাংশ-তোমার চোখের বিজলী-উজল আলোকে‌, পরাণে আমার ঝঞ্ঝার মেঘ ঝলকে।–তারপর আর সব পৃষ্ঠা শূন্য।

অটোগ্রাফের খাতাটি যে দীপার তাতে সন্দেহ নেই। কারণ‌, মলাটের ওপরেই তার নাম লেখা রয়েছে।

যিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা একটু মোচড় দিয়ে উদ্ধৃত করেছেন তাঁর নামটি অপরিচিত নয়‌, তিনি বিশেষ একটি আড্ডার নিয়মিত সভ্য।

ব্যোমকেশ খাটো গলায় বলল–’হুঁ! আমাদের সন্দেহ তাহলে মিথ্যে নয়।’

বাইরে পায়ের শব্দ শোনা গেল। ব্যোমকেশ চট্ট করে অটোগ্রাফের খাতাটি পকেটে পুরে রাখালবাবুকে চোখের ইশারা করল।

বিজয় দুহাতে দু’ পেয়ালা চা নিয়ে এসে টেবিলের ওপর রাখল‌, বলল—’আসুন। কিছু পেলেন?’

রাখালবাবু কেবল গলার মধ্যে শব্দ করলেন‌, ব্যোমকেশ চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলল—’সত্যান্বেষণের পথ বড় দুৰ্গম। কোথায় কোন কানা গলির মধ্যে সত্য লুকিয়ে আছে‌, কে বলতে পারে! যাহোক‌, নিরাশ হবেন না‌, দু-চার দিনের মধ্যেই আসামী ধরা পড়বে।’

তারপর দু’জনে চা খেয়ে বেরিয়ে পড়ল। রাস্তায় যেতে যেতে রাখালবাবু বললেন–তাহলে এখন বাকি রইল শুধু আসামীকে গ্রেপ্তার করা। অবশ্য পাকা রকম সাক্ষীসাবুদ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে পাকড়ানো যাবে না।’

ব্যোমকেশ বলল-না‌, তাকে পাকড়াবার একটা ফন্দি বার করতে হবে। কিন্তু তার আগে নিঃসংশয়ভাবে জানা দরকার‌, দেবাশিসের স্ত্রী এ ব্যাপারে কতখানি লিপ্ত আছে।’

হাসপাতালে ডাক্তার গুপ্ত ব্যবস্থা করে দিলেন। একটি নিভৃত ঘরে দীপার সঙ্গে ব্যোমকেশ ও রাখালবাবুর কথা হল। ব্যোমকেশ বলল–’আমরা আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। কেন প্রশ্ন করতে চাই এখন জানতে চাইবেন না‌, পরে আপনিই জানতে পারবেন।’

দীপা সহজভাবে বলল—’কি জানতে চান‌, বলুন।’ তার মুখে আতঙ্কের ভাব আর নেই‌, সে তার স্বাভাবিক সাহস অনেকটা ফিরে পেয়েছে।

সওয়াল জবাব আরম্ভ হল। রাখালবাবু অচঞ্চল চোখে দীপার মুখের পানে চেয়ে রইলেন।

ব্যোমকেশ বলল–’নৃপতি লাহা নামে একটি ভদ্রলোকের বাড়িতে যাঁদের নিয়মিত আড্ডা বসে তাঁদের আপনি চেনেন?

দীপার চোখের দৃষ্টি সতর্ক হল‌, সে বলল—’হ্যাঁ‌, চিনি। ওঁরা সবাই আমার দাদার বন্ধু।’

‘ওঁরা আপনার বাপের বাড়িতে যাতায়াত করেন?’

‘বাড়িতে কাজকর্ম থাকলে আসেন।’

‘এঁদের নাম নৃপতি লাহা‌, সুজন মিত্র‌, কপিল বসু প্রবাল গুপ্ত‌, খড়্গ বাহাদুর। এঁদের ছাড়া আর কাউকে চেনেন?’

50 Shares