শজারুর কাঁটা

‘না‌, কেবল এদেরই চিনি।’

‘আচ্ছা‌, নৃপতি লোহা বিপত্নীক আপনি জানেন?’

‘…যেন শুনেছিলাম।’

‘এঁদের মধ্যে আর কারুর বিয়ে হয়েছে কিনা জানেন?’

বোধহয়আর কারুর বিয়ে হয়নি

‘প্রবাল গুপ্ত কি বিবাহিত?’

‘ঠিক জানি না…বোধ হয় বিবাহিত নয়।’

‘প্রবাল গুপ্ত বিবাহিত…সম্প্রতি স্ত্রী-বিয়োগ হয়েছে।’

‘…আমি জানতাম না।’

‘যাক। কপিল বসু লোকটিকে আপনার কেমন লাগে?

‘ভালই তো।’

‘ওর সম্বন্ধে কোনো কুৎসা শুনেছেন?’

‘না।’

‘আর সুজন মিত্র? সে সিনেমার আর্টিস্ট‌, তার সম্বন্ধে কিছু শোনেননি?’

‘না‌, ও-সব আমি কিছু শুনিনি।’

‘আপনি সিনেমা দেখতে ভালবাসেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘সুজন মিত্রের অভিনয় কেমন লাগে?

‘খুব ভাল।’

‘উনি কেমন লোক?’

‘দাদার বন্ধু‌, ভালই হবেন। দাদা মন্দ লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন না।’

‘তা বটে। আপনি ফুটবল খেলা দেখেছেন?’

‘ছেলেবেলায় দেখেছি‌, যখন স্কুলে পড়তুম।’

‘খড়্গ বাহাদুরের খেলা দেখেছেন?’

‘না… রেডিওতে খেলার কমেন্টারি শুনেছি।’

‘এবার শেষ প্রশ্ন। —আপনার স্বামীর হৃদযন্ত্র বুকের ডান দিকে আপনি জানেন?’

ব্যোমকেশ ভ্রূ তুলে চাইল-‘জানেন?’

‘হ্যাঁ, কিছুদিন আগে দুপুর রাত্রে আমার স্বামীর কম্প দিয়ে জ্বর এসেছিল। আমাকে ডাক্তার ডাকতে বললেন। আমি জানতুম না ওঁদের পারিবারিক ডাক্তার কে‌, তাই আমার বাপের বাড়ির ডাক্তারকে ফোন করলাম। সেনকাকা এসে ওঁকে পরীক্ষা করলেন‌, তারপর যাবার সময় আমাকে আড়ালে বলে গেলেন যে‌, ওঁর হৃদযন্ত্র উল্টে দিকে। এরকম নাকি খুব বেশি দেখা যায় না।’

প্রকাণ্ড হাফ-ছাড়া নিশ্বাস ফেলে ব্যোমকেশ উঠে দাঁড়াল‌, বলল—’আমার বুক থেকে একটা বোঝা নেমে গেল। আর কিছু জানবার নেই‌, আপনি স্বামীর কাছে যান। — চলো রাখাল।’

হাসপাতালের বাইরে এসে ব্যোমকেশ রাখালবাবুকে প্রশ্ন করল—’কি দেখলে? কি বুঝলে?’ রাখালবাবু বললেন–কোনো ভুল নেই‌, মেয়েটি নির্দোষ। প্রতিক্রিয়া যখন যেমনটি আশা করা গিয়েছিল‌, ঠিক তেমনটি পাওয়া গেছে। এখন কিং কর্তব্য?’

ব্যোমকেশ বলল—‘এখন তুমি থানায় যাও‌, আমি বাড়ি যাই। ভাল কথা‌, একটা বুলেট-প্রুফ গেঞ্জি যোগাড় করতে পার?’

‘পারি। কী হবে?’

‘একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে। আজ রাত্রে গেঞ্জি নিয়ে আমার বাড়িতে এস‌, তখন বলব?’

সন্ধ্যের পর ব্যোমকেশ একা নৃপতির আড্ডায় গেল। সকলেই উপস্থিত ছিল‌, ব্যোমকেশকে ছেঁকে ধরল। নৃপতি তার সামনে সিগারেটের কৌটো খুলে ধরে বলল—’খবর নিয়েছি। দু-এক দিনের মধ্যেই দেবাশিসকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেবে। ওর বিপন্মুক্তি উপলক্ষে আমি পার্টি দেব‌, আপনাকে আসতে হবে।’

ব্যোমকেশ বলল–’নিশ্চয় আসব।’

কপিল ব্যোমকেশের গা ঘেঁষে বসে আবদারের সুরে বলল–’আপনার সত্যান্বেষণ কত দূর অগ্রসর হল‌, বলুন না ব্যোমকেশবাবু।’

ব্যোমকেশ হেসে বলল—’দিল্লী দূরস্ত। শজারুর কাঁটার ওস্তাদটি কে তা এখনো জানা যায়নি। তবে একটা থিওরি খাড়া করেছি।’

সুজন গলা বাড়িয়ে বলল—’কি রকম থিওরি?’

ব্যোমকেশ সিগারেটে কয়েকটা ধীর মন্থর টান দিয়ে বলতে আরম্ভ করল—’ব্যাপারটা হচ্ছে এই। কোনো একজন অজ্ঞাত লোক শজারুর কাঁটা দিয়ে প্রথমে একটা ভিখিরিকে খুন করল‌, তারপর এক মজুরকে খুন করল‌, তারপর আবার খুন করল এক দোকানদারকে। এবং সর্বশেষে দেবাশিসবাবুকে খুন করবার চেষ্টা করল। চার বারই অস্ত্র হচ্ছে শজারুর কাঁটা। অর্থাৎ হত্যাকারী জানাতে চায় যে চারটি হত্যাকার্য একই লোকের কাজ।

‘এখন হত্যাকারী যদি পাগল হয় তাহলে কিছুই করবার নেই। পাগল অনেক রকম হয়; এক ধরনের পাগল আছে যাদের পাগল বলে চেনা যায় না; তারা অত্যন্ত ধূর্ত‌, তাদের খুন করার কোনো যুক্তিসঙ্গত মোটিভ থাকে না। এই ধরনের পাগলকে ধরা বড় কঠিন।

‘কিন্তু যদি পাগল না হয়? যদি পুলিসের চোখে ধুলো দেবার জন্যে কেউ পাগল সেজে শজারুর কাঁটার ফন্দি বার করে থাকে? মনে করুন‌, দেবাশিসবাবুর এমন কোনো গুপ্ত শত্ৰু আছে। যে তাঁকে খুন করতে চায়। সরাসরি খুন করলে ধরা পড়ার ভয় বেশি‌, তাই সে ভিখিরি খুন করে কাজ আরম্ভ করল; তারপর মজুর‌, তারপর দোকানদার‌, তারপর দেবাশিসবাবু। স্বভাবতাই মনে হবে দেবাশিসবাবু হত্যাকারীর প্রধান লক্ষ্য নয়‌, একটা বিকৃতমস্তিষ্ক লোক যখন যাকে সুবিধে পাচ্ছে খুন করে যাচ্ছে। হত্যাকারী যে দেবাশিসবাবুকেই খুন করবার জন্যে এত ভণিতা করেছে। তা কেউ বুঝতে পারবে না। —এই আমার থিওরি।’

কিছুক্ষণ ঘর নিস্তব্ধ হয়ে রইল‌, তারপর নৃপতি বলল—’কিন্তু মনে করুন। এর পর আবার একটা খুন হল শজারুর কাঁটা দিয়ে! তখন তো বলা চলবে না যে দেবাশিসই হত্যাকারীর আসল লক্ষ্য।’

ব্যোমকেশ বলল–’না। তখন আবার নতুন রাস্তা ধরতে হবে।’

কপিল বলল–’খুনীকে কি ধরা যাবে?

ব্যোমকেশ বলল–’চেষ্টার ত্রুটি হবে না।’

এমন সময় কফি এল। প্রবাল উঠে গিয়ে পিয়ানোতে মৃদু টুং-টাং আরস্তু করল। ব্যোমকেশ কফি শেষ করে আরো কিছুক্ষণ গল্পসল্প করে বাড়ি ফিরে চলল।

ব্যোমকেশ বাড়ি ফিরে আসার কয়েক মিনিট পরে পৌনে ন’টার সময় রাখালবাবু এলেন। তাঁর হাতে একটি মোড়ক। ব্যোমকেশ বলল–’এনেছ?’

রাখালবাবু মোড়ক খুলে দেখালেন; ব্রোকেডের মত কাপড় দিয়ে তৈরি একটি ফতুয়া‌, কিন্তু সোনালী বা রূপালী জরির ব্রোকোড নয়‌, স্টীলের জরি দিয়ে তৈরি। ঘন-পিনদ্ধ লৌহ-জালিক। জামার ভিতরে পরলে বাইরে থেকে বোঝা যায় না‌, কিন্তু এই কঠিন বর্ম ভেদ করা ছোরাছুরি তো দূরের কথা‌, পিস্তল রিভলবারেরও অসাধ্য।

50 Shares