শজারুর কাঁটা

ব্যোমকেশ জামাটি নিয়ে নেড়েচেড়ে পাশে রাখল‌, বলল—’আমার গায়ে ঠিক হবে। এখন আর একটা কথা বলি; আমাদের শজারুর পিছনে লেজুড় লাগাবার ব্যবস্থা করেছ?’

রাখালবাবু বললেন–সব ব্যবস্থা হয়েছে। আজ রাত্ৰি সাতটা থেকে লেজুড় লেগেছে‌, এক লহমার জন্যে তাকে চোখের আড়াল করা হবে না। দিনের বেলাও তার পিছনে লেজুড় থাকবে।’

ব্যোমকেশ বলল–’বেশ। এখন এস পরামর্শ করি। আমি পুকুরে চার ফেলে এসেছি–’

খাটো গলায় দু’জনের মধ্যে অনেকক্ষণ পরামর্শ হল। তারপর সাড়ে ন’টা বাজলে রাখালবাবু ওঠবার উপক্রম করছেন‌, এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল।

ব্যোমকেশ ফোন তুলে নিয়ে বলল—’হ্যালো।’

অপর প্রাস্ত থেকে চেনা গলা শোনা গেল–’ব্যোমকেশবাবু? আপনি একলা আছেন?’

ব্যোমকেশ রাখালবাবুর দিকে সঙ্কেত-ভরা দৃষ্টিপাত করে বলল—’হ্যাঁ‌, একলা আছি। আপনি–’

‘গলা শুনে চিনতে পারছেন না?’

‘না। আপনার নাম?’

‘যখন গলা চিনতে পারেননি। তখন নাম না জানলেও চলবে। আজ সন্ধ্যের পর আপনি যেখানে গিয়েছিলেন সেখানে আমি ছিলাম। একটা গোপন খবর আপনাকে দিতে চেয়েছিলাম‌, কিন্তু সকলের সামনে বলতে পারলাম না।’

‘গোপন খবর! শজারুর কাঁটা সম্বন্ধে?’

‘হ্যাঁ। আপনি যদি আজ রবীন্দ্র সরোবরের বড় ফটকের কাছে আসেন আপনাকে বলতে পারি।‘

‘বেশ তো‌, বেশ তো। কখন আসব বলুন।’

‘যত শীগগির সম্ভব। আমি অপেক্ষা করব। একলা আসবেন কিন্তু। অন্য কারুর সামনে আমি কিছু বলব না।’

‘বেশ। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেরুচ্ছি।’

টেলিফোন রেখে ব্যোমকেশ যখন রাখালবাবুর দিকে তাকাল তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। পাঞ্জাবির বোতাম খুলতে খুলতে সে বলল‌, ‘টোপ ফেলার সঙ্গে সঙ্গে মাছ টোপ গিলেছে। এত শীগগির ওষুধ ধরবে ভাবিনি। রাখাল‌, তুমি—’

ব্যোমকেশ পাঞ্জাবি খুলে ফেলল‌, রাখালবাবু তাকে বুলেট-প্রুফ ফতুয়া পরাতে পরাতে বললেন—’আমার জন্যে ভাববেন না‌, আমি ঠিক যথাস্থানে থাকব। শজারুর পিছনে লেজুড় আছে‌, তিনজনে মিলে শজারুকে কাবু করা শক্ত হবে না।’

‘বেশ।’

ব্যোমকেশ ফতুয়ার ওপর আবার পাঞ্জাবি পরিল‌, তারপর রাখালবাবুর দিকে একবার অর্থপূর্ণ ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে গেল। রাখালবাবু কব্জিতে ঘড়ি দেখলেন‌, দশটা বাজতে কুড়ি মিনিট। তিনিও বেরিয়ে পড়লেন। প্রচ্ছন্নভাবে যথাস্থানে যথাসময়ে উপস্থিত থাকতে হবে।

রবীন্দ্র সরোবরের সদর ফটকের সামনে লোক চলাচল নেই; কদাচিৎ একটা বাস কিংবা মোটর হুস করে সাদার্ন অ্যাভেনু দিয়ে চলে যাচ্ছে।

ব্যোমকেশ দ্রুতপদে সাদার্ন অ্যাভেনু রাস্তা পেরিয়ে ফটকের সামনে গিয়ে দাঁড়াল; এদিক-ওদিক তাকাল কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। রবীন্দ্র সরোবরের ভিতরে আলো-আঁধারিতে জনমানব চোখে পড়ে না।

ব্যোমকেশ ফটকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে খানিক ইতস্তত করল‌, তারপর ভিতর দিকে অগ্রসর হল। দু-চার পা এগিয়েছে‌, একটি লোক অদূরের গাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল‌, হাত তুলে ব্যোমকেশকে ইশারা করে ডাকল। ব্যোমকেশ তার কাছে গেল‌, লোকটি বলল‌, চলুন‌, ওই বেঞ্চিতে বসা যাক।।’

জলের ধারে গাছের তলায় বেঞ্চি পাতা। ব্যোমকেশ গিয়ে বেঞ্চিতে ডানদিকের কিনারায় বসল। চারিদিকের ঝিকিমিকি আলোতে অস্পষ্টভাবে মুখ দেখা যায়‌, তার বেশি নয়। ব্যোমকেশ বলল—‘এবার বলুন‌, আপনি কি জানেন।’

লোকটি বলল–’বলছি। দেখুন‌, যার কথা বলতে চাই সে আমার ঘনিষ্ঠ লোক‌, তাই বলতে সঙ্কোচ হচ্ছে। সিগারেট আছে?’

ব্যোমকেশ সিগারেটের প্যাকেট বার করে দিল; লোকটি সিগারেট নিয়ে প্যাকেট ব্যোমকেশকে ফেরত দিল‌, নিজের পকেট থেকে বোধকরি দেশলাই বার করতে করতে হঠাৎ বলে উঠল—’দেখুন‌, দেখুন কে আসছে।’ তার দৃষ্টি ব্যোমকেশকে পেরিয়ে পাশের দিকে প্রসারিত‌, যেন ব্যোমকেশের দিক থেকে কেউ আসছে।

ব্যোমকেশ সেই দিকে ঘুরে বসল। সে প্রস্তুত ছিল‌, অনুভব করল তার পিঠের বাঁ দিকে বুলেট-প্রুফ আবরণের ওপর চাপ পড়ছে। ব্যোমকেশ বিদ্যুদ্বেগে পিছু ফিরল। লোকটি তার পিঠে শজারুর কাঁটা বিঁধিয়ে দেবার চেষ্টা করছিল‌, পলকের জন্যে হতবুদ্ধির মত চাইল‌, তারপর দ্রুত উঠে পালাবার চেষ্টা করল। কিন্তু ব্যোমকেশের বজ্রমুষ্টি লোহার মুগুরের মত তার চোয়ালে লেগে তাকে ধরাশায়ী করল।

ইতিমধ্যে আরো দু’টি মানুষ আলাদিনের জিনের মত আবির্ভূত হয়েছিল‌, তারা ধরাশায়ী লোকটির দু’হাত ধরে টেনে দাঁড় করাল। রাখালবাবু তার হাত থেকে শজারুর কাঁটা ছিনিয়ে নিয়ে বললেন–’প্রবাল গুপ্ত‌, তুমি তিনজনকে খুন করেছ এবং দু’জনকে খুন করবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছ। চল‌, এবার থানায় যেতে হবে।’

১০

হাপ্ত দুই পরে একদিন মেঘাচ্ছন্ন সকালবেলা ব্যোমকেশের বসবার ঘরে পারিবারিক চায়ের আসর বসেছিল। অজিত ছিল‌, সত্যবতীও ছিল। গত রাত্রি থেকে বর্ষণ আরম্ভ হয়েছে‌, মাঝে মাঝে থামছে‌, আবার আরম্ভ হচ্ছে। গ্রীষ্মের রক্তিম ক্ৰোধ মেহে বিগলিত হয়ে গেছে।

অজিত বলল–’এমন একটা গাইয়ে লোককে তুমি পুলিসে ধরিয়ে দিলে! লোকটা বড় ভাল গায়।–সত্যিই এতগুলো খুন করেছে?’

সত্যবতী বলল—’লোকটা নিশ্চয় পাগল।’

ব্যোমকেশ বলল—’প্রবাল গুপ্ত পাগল নয়; কিন্তু একেবারে প্রকৃতিস্থ মানুষও নয়। অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে ছিল‌, হঠাৎ দৈব-দুর্বিপাকে গরীব হয়ে গেল; দারিদ্র্যের তিক্ত রসে ওর মনটা বিষিয়ে উঠল। ওর চরিত্রে ষড়রিপুর মধ্যে দুটো বলবান-লোভ আর ঈর্ষা। দারিদ্র্যের আবহাওয়ায় এই দুটো রিপু তাকে প্রকৃতিস্থ থাকতে দেয়নি।’

50 Shares